ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

হাঙরে ঝুঁকছেন জেলেরা

ডেস্ক রিপোর্ট
🕐 ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ৩০, ২০১৯

দেশের উপকূলে জেলেরা যেভাবে নির্বিচারে হাঙর শিকার করছেন তাতে হুমকির মুখে পড়েছে এই প্রজাতি। এমনটাই বলছেন মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তা ও গবেষকরা। আইন অনুযায়ী হাঙর ধরা নিষিদ্ধ হলেও সমুদ্রে গত কয়েকদিনে বরগুনা এবং ভোলায় জেলেদের কাছ থেকে ডলফিনসহ অন্তত ৫০ মণ হাঙর জব্দ করা হয়।

গত বৃহস্পতিবার ভোলায় সদর উপজেলার পূর্ব ইলিশা ফেরিঘাট এলাকা থেকে ৪০ মণ হাঙর ও ডলফিনের পোনা জব্দ করে দক্ষিণাঞ্চলীয় কোস্টগার্ড। চট্টগ্রামগামী একটি কাভার্ড ভ্যান থেকে পোনাগুলো জব্দ করা হয়। এ সময় কাভার্ড ভ্যানের চালক আনিসুর রহমানকে (২৪) আটক করা হয়। পরে জব্দকৃত পোনাগুলো বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ভোলা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামাল হোসেন বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ অনুযায়ী চালক আনিসুরকে এক মাসের কারাদ- দেন এবং পোনাগুলোকে মাটিতে পুঁঁতে ফেলার নির্দেশ দেন।

উপকূলীয় বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) তৌফিকুল ইসলাম বলেন, জেলেরা গভীর সমুদ্র থেকে পোনাগুলো শিকার করেছেন। শিকারের পর পোনাগুলো ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার কচ্ছপিয়া এলাকায় নিয়ে আসেন। সেখান থেকে পলিথিনে মুড়ে বরফ দিয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে পোনাগুলো শুকিয়ে পাউডার বানিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়।

ডিএফও তৌফিকুল ইসলাম আরও বলেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ অনুযায়ী এসব পোনা শিকার নিষিদ্ধ। অনেকেই এই আইন জানেন না। সবাইকে সচেতন করতে বন বিভাগ চেষ্টা করছে। ভোলার দুটি ফেরিঘাটে চেকপোস্ট বসানো উচিত। এতে কাঠ ও বন্য প্রাণী পাচারকারীদের আটক করা সহজ হবে।

এর আগে গত ২৪ নভেম্বর বরগুনার পাথরঘাটার নতুন বাজার খাল সংলগ্ন শুঁটকি পল্লী থেকে ১০ হাজার হাঙরের বাচ্চা জব্দ করেন কোস্টগার্ডের পাথরঘাটা স্টেশনের সদস্যরা। এ সময় দুইজনকে আটক করা হয়। আটক দুজনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

এক প্রতিবেদনে বিবিসি বাংলা বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে হাঙরের পাখার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আর সেই সুযোগ নিতে দেশের কিছু অসাধু জেলে শিকার নিষিদ্ধ হাঙর ধরে এর পাখা কেটে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। এর ফলে আশঙ্কাজনক হারে কমছে হাঙর। কারণ, একটি লাখ লাখ ডিম দিলেও হাঙর ডিম দেয় না, বাচ্চা প্রসব করে। সঙ্গত কারণেই, এই হাঙরের সংখ্যা সমুদ্রে কম থাকে।

জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াইল্ডএইড বলছে, প্রতি বছর ১০ কোটি হাঙর শিকার করা হয়। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত কোটি হাঙর শিকার করা হয় শুধু তাদের পাখা সংগ্রহ করার জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে হাঙরের পাখা দিয়ে তৈরি স্যুপ খাবার প্রবণতা কমে আসলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে এটি বেশ জনপ্রিয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে জেলেরা যেসব হাঙর ধরে সেগুলোর পাখা আলাদা করে সেসব দেশে-বিদেশে পাঠানো হয়। বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে শুধু পাখা বা ডানা সংগ্রহের জন্য পুরো মাছ মেরে ফেলা হচ্ছে, পুরোটা ব্যবহার হচ্ছে না।

বাংলাদেশ মৎস্য অধিদফতরের আওতাধীন সামুদ্রিক মৎস্য দফতরের পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, হাঙর ধরা এবং বিদেশে পাঠানো অবৈধ। পুরো কাজটি গোপনে করা হয়।

দেশ থেকে হাঙর কোথায় যায়- এমন প্রশ্নে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে হাঙরের পাখা দিয়ে এক ধরনের স্যুপ তৈরি করা হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে হাঙরের পাখা চীন, হংকং, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুরে যায়। হাঙর ধরার পর পাখনা আলাদা করে বাকি হাঙর ফেলে দেওয়া হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ হাঙর মাছ খায় না। তা ছাড়া বিদেশে হাঙরের পাখার চাহিদাই বেশি।

জেলেরা কেন হাঙর ধরছেন? মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের উপকূলে এখন দামি মাছ ধরার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। যেমন রূপচাঁদা, লাক্ষ্যা, বড় পোয়া মাছ আশঙ্কাজনক হারে কমছে বলে তারা বলছেন। ফলে জেলেরা হাঙর ধরার দিকে ঝুঁকছেন।

অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, জেলেরা এখন বিকল্প জিনিস খুঁজছেন। কিছু না কিছু তো তাদের করতে হবে। এজন্য জেলেরা হাঙর ধরার দিকে ঝুঁকছেন। অনিয়ন্ত্রিত এবং অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের কারণে দামি মাছ কমে যাচ্ছে।

কক্সবাজারের একজন মৎস্যজীবী জানিয়েছেন, সাধারণ মাছ ধরার চেয়ে হাঙর ধরা বেশি লাভজনক। মাছ সবসময় সমানভাবে ধরা পড়ে না। সেজন্য অনেকে মাছ না পাইলে হাঙর ধরে। আবার অনেকে আছে হাঙর ধরার জন্যই সুমদ্রে যান।

সামুদ্রিক মৎস্য দফতরের পরিচালক শরীফ উদ্দিন বলছেন, বঙ্গোপসাগরে হাঙর যে হুমকির মুখে রয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একটি মাছ লাখ লাখ ডিম দেয়। কিন্তু হাঙর কোনো ডিম দেয় না, তারা বাচ্চা প্রসব করে। স্বাভাবিকভাবেই হাঙরের সংখ্যা কম হয়। এভাবে হাঙর ধরতে থাকলে এটি শেষ হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের জেলেরা ২০০ থেকে ২৫০ কেজি পর্যন্ত ওজনের হাঙর ধরে। এমন প্রমাণ মিলেছে বলে তিনি জানান। হাঙরের পাখা আলাদা করার পর বাকি অংশ শুকিয়ে শুটকি তৈরি করা হয়। এ ছাড়া উপজাতীয়দের কাছে শুকনো হাঙরের চাহিদা রয়েছে বলে বলছেন মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা।

 
Electronic Paper