ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পাতিলে ভেসে স্কুলে যায় তারা

আল আমিন, রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী)
🕐 ৪:০২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৭, ২০২২

পাতিলে ভেসে স্কুলে যায় তারা

ভেসে ভেসে স্কুল যায় ওরা! শুনতে অবাক লাগলেও এমন চিত্র চোখে পড়েছে পটুয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজ (দক্ষিণ অংশ) গ্রাম নামক দুইটি চরে। ঘড়ির কাটায় সকাল ১০টা। স্কুল শুরুর ঘন্টা বাজতে তখন ৩০ মিনিট বাকি । এরই মধ্যে স্কুলে যাওয়ার তরিগরি। বাড়ি থেকে বই-খাতা-কলমের সঙ্গে রান্নার পাতিল নিয়ে রওনা করে কয়েকজন শিশু শিক্ষার্থী। সেই পাতিলের মধ্যে বইপুস্তক আর স্কুলের পোশাক নিয়ে রওনা করে ওরা।

 

এর মাঝপথেই খাল। সেই খালে পাতিল ভাসিয়ে সাঁতরে সাঁতরে তীরে ওঠে শিশুরা। ২৫০ ফুটের বেশি চওড়া খাল পেড়ুতে সময় লেগেছে ওদের ৪-৫ মিনিট। শীতল পানিতে সাতরে কাঁপছিলও দুই-একজন। তবুও ভেজা জামা কাপড় রোদে শুকিয়ে স্কুল পোশাকে ক্লাসে ছুঁটে যায় ওরা।

এই চিত্র প্রতিবেদকের কাছে নতুন হলেও স্থানীয়দের কাছে পুরনো। রাঙ্গাবালী উপজেলার বিচ্ছিন্ন ইউনিয়নের চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজ (দক্ষিণ অংশ) গ্রাম নামক দুইটি চর থেকে এভাবে খাল সাঁতরে স্কুলে আসা-যাওয়া করে প্রায় অর্ধশত শিশু শিক্ষার্থী।

খাল সাতরে স্কুলে যাওয়া ওদের মধ্যেরই একজন শিক্ষার্থী জান্নাতুল (৮)। তৃতীয় শ্রেণী পড়ুয়া এ শিক্ষার্থীর বাড়ি দিয়ারচর গ্রামে। পড়ালেখা করে মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এর মাঝখানে বয়ে যাওয়া বাইলাবুনিয়া নামক একটি খাল সাঁতরে ওর যেতে হয় স্কুলে।

জান্নাতুল বলে, ‘আমাদের আসতে অনেক ভয় হয়। দুই-এক সময় হাত থেকে পাতিল ছুইট্টা (ছুটে) যায়। আমরা অনেক কষ্ট করি। দুই তিনদিন আগে হাত থেকে পাতিল ছুইট্টা গেছে। আমরা অনেক কান্না করছি। কেউ ছিল না, পরে আমরাই আস্তে আস্তে কিনারে আসছি। বই খাতা ভিজে গেছে। এখনও শুকায়নি।’

জান্নাতুলের মত ওই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর নাসরিন, চতুর্থ শ্রেণীর কেয়ামনি, নাজমুলের ভাষ্যখাল সাঁতরে স্কুলে যেতে ভয় করে ওদের। কষ্ট হয় এই শীতে খাল পার হতেও।তাই শিশু শিক্ষার্থীদের দাবিখালটিতে একটি সেতু নির্মাণের।


স্থানীয় লোকজন জানায়, উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজ (দক্ষিণ অংশ) গ্রামে কোন স্কুল নেই। তাই পার্শ্ববর্তী মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে ওই দুই চরের শিশুরা।

কিন্তু স্কুল এবং দুই চরের মাঝখানে বাইলাবুনিয়া খাল। এ খাল পেড়িয়ে স্কুলে যেতে হয় শিশুদের। কেউ খাল সাতরে পার হয়। কেউ আবার পার হয় নৌকায়। কাচা হাতে নিজেই নৌকার বৈঠা বেয়ে খাল পার হওয়া দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইউসূফ বলে, ‘যহন (যখন) নৌকা পাই, তহন স্কুলে আই (আসি)।’

স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, স্থানীয়দের উদ্যোগে কয়েকবার বাশের সাঁকো নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু নোনা জলে সাঁকো বেশিদিন টিকে না। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে সাঁকো থাকাকালীন ৩০০-৪০০ শিক্ষার্থী ছিল। এরমধ্যে দুই শ’ এর মতো শিক্ষার্থী ছিল ওই দুই চরের। সাঁকো না থাকায় এখন শিক্ষার্থী কমে

গেছে। এখন দুই চর থেকে ৫০ জনের মত শিক্ষার্থী আসে। এদের কেউ কেউ নিয়মিত আসেও না। শিক্ষার্থী অভিভাবক দিয়ারচর গ্রামের হোসেন মিয়া বলেন, ‘আমার দুই ছেলে এই স্কুলে পড়ে। সপ্তাহখানেক আগে আমার এক ছেলে খাল পার হতে গিয়ে ডুবে যাওয়া ধরছে।

আমি এসে উডাউয়া (উঠিয়ে) স্কুলে দিয়ে গেছি। আমার অনেক কষ্টে এই দুই ছেলে এখন স্কুলে আনা-নেওয়া করতে হয়। এর চেয়ে এখানে একটি স্কুল হলে ভাল হয়। আর তানাহলে এই খালে একটি ব্রিজ হলেও ছেলে মেয়েদের স্কুলে পড়তে দেওয়া যায়।’

মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজের শিক্ষার্থীরা পাতিল নিয়ে খাল সাতরে এই বিদ্যালয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসে। অনেক অভিভাবকই এই ঝুঁকি নিয়ে ছেলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে আসতে দেয় না।

যদি স্কুলের পূর্ব পাশের এই খালে একটি ব্রিজ হতো, তাহলে শিশু শিক্ষার্থীরা এই ঝুঁকি থেকে রেহাই পেত।এই শীতের সময়ে শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট হয়। অনেকেই প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ঘুরে স্কুলে আসে। অনেকে নিয়মিত স্কুলেও আসতে পারে না।’

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্গম এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা একটি খাল পেড়িয়ে আমাদের স্কুলে আসতে হয়। সেখানে একটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য বেশকিছুদিন আগে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা দিয়েছি। এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে বিকল্প কি করা যায় এজন্য আমরা উর্ধ্বতণ কর্তৃপক্ষ, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আছে তাদের সাথে আলাপ করে অতিদ্রুত বিষয়টি সমাধাণের চেষ্টা করবো।’

এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী মিজানুল কবির বলেন, ‘আমরা সেখানকার খোঁজখবর নিব। প্রয়োজনে ব্রিজ নির্মাণের জন্য আয়রণ ব্রিজ প্রকল্পে প্রস্তাবনা পাঠাবো।’ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা জেনেছি স্কুলে যেতে শিশু শিক্ষার্থীরা বই-খাতা এবং জামা-কাপড় পাতিলে ভরে সাতার কেটে স্কুলে যায়। যেটা জেনে আমার কাছে খুব খারাপ লেগেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। আগামী দিনে কোমলমতি শিশুরা যাতে সুন্দরভাবে স্কুলে যেতে পারে সেজন্য আমরা উর্ধ্বতণ কর্তৃপক্ষকে জানাবো। এবং কোমলমতি শিশুদের পারাপারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ সালেক মূহিদ জানান, ‘৭ ডিসেম্বর আমাদের মাসিক মিটিংয়ে এ বিষয়টি আমরা উত্থাপন করবো। দ্রুত বিষয়টি সমাধাণের জন্য রাজস্ব তহবিল অথবা পিআইও অফিসের প্রকল্পের মাধ্যমে ওখানে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।’

 
Electronic Paper