ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘ওরে ভাই পি কে হালদারের বাড়ি মাটিভাঙ্গায় এ পরিচয় দিতে লজ্জা করে’

আরিফ মোস্তফা, পিরোজপুর
🕐 ৮:২৮ অপরাহ্ণ, মে ১৫, ২০২২

‘ওরে ভাই পি কে হালদারের বাড়ি মাটিভাঙ্গায় এ পরিচয় দিতে লজ্জা করে’

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের দীঘিরজান গ্রামে বাড়ী অর্থলুটকারী প্রশান্ত কুমার হালদারে (পি কে হালদার)। তার বাবার নাম মৃত প্রণবেন্দু হালদার। ভারতে আটক হওয়ার খবর পেয়ে যোগাযোগ করা মাটিভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম বিলুর সাথে। জাহিদুল ইসলাম বিলু ছাত্র ইউনিয়ন পিরোজপুর জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি। এ ছাড়া তিনি কমিনিউনিষ্ট পার্টির সদস্য। রবিবার তার কাছে জানতে চাওয়া হয় পি কে হালদারের বাড়ী মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নে কিনা?

উত্তরে তিনি বলেন পি কে হালদারের বাড়ী মাটিভাঙ্গায় এ পরিচয় পত্রিকায় দিয়েন না। পরে অবশ্য তিনি বলেন, ইউনিয়নের এক কানায় দীঘিরজান গ্রামে পি কে হালদারের বাড়ী। জাহিদুল ইসলাম বিলু বলেন, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের বাড়ী মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের তারাবুনিয়া গ্রামে। আর সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দারের বাড়ী বরইবুনিয়া গ্রামে ও মাহামুদকান্দা গ্রামে সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর। এ ছাড়া ন্যাপ কেন্ত্রীয় কিমিটির সাবেক সহ সভাপতি বরিশাল জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আঃ সাত্তার মিয়ার বাড়ীও বরইবুনিয়া গ্রামে। অনেক গুনী মানুষের জন্ম যে মাটিভাঙ্গায় সেখানে বিপুল পরিমান অর্থলুটকারী পি কে হালদারের বাড়ী ওরে ভাই এ পরিচয় দিতে আমাদের এখন লজ্জা করে।

পি কে হালদার এলাকায় আসতেন কিনা জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, খুব কম আসতো। এরপর তিনি বলেন, একবার ম্যানেজিং কমিটির সভা চলাকালে পি কে হালদার সভার বাহিরে থাকা এব ব্যাক্তিকে উদ্দেশ্য করে অশালীন কথা বলে। বিষয়টি ঐ ব্যাক্তির কানে গেলে সে সভায় ঢুকে পি কে হালদারকে একটা থাপ্পর মারে। এরপর থেকে পি কে হালদার বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভায় আর যোগ দেয়নি।

জাহিদুল ইসলাম বিলু বলেন, ভারতে আটক বাংলাদেশের হাজার কোটি টাকা পাচারকারী প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)সহ তার সিণ্ডিকেটের প্রধান সহযোগীও কয়েক সদস্যের বাড়ী নাজিরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের। কয়েকমাস আগে দুদকের হাতে গ্রেফতার হওয়া পি কে হালদারের তিন সহযোগী অবন্তিকা বড়াল, সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা

মৃধার বাড়িও নাজিরপুর উপজেলায়। ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, দর্জি ব্যবসায়ী মৃত প্রণবেন্দু হালদার এর বড় ছেলে পি কে হালদারসহ তার সহযোগীরা একবারে সাধারণ পরিবারের সন্তান হয়েও তারা এখন অনেক অর্থ সম্পত্তির মালিক। ঢাকায় দামী ফ্লাটবাড়িসহ দেশে বিদেশে রয়েছে তাদের অর্থ ও সম্পত্তি। পশ্চিম বঙ্গের অশোক নগরে তার প্রধান সহযোগী সুকুমার মৃধার মাধ্যমে যে কয়েকটি বাড়ী ও বিপুল জমিজমা কিনেছেন তার প্রমাণ ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ অনুসন্ধানে পেয়েছে।

পি কে হালদারের সবযোগী সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতার পৈত্রিক বাড়ি নাজিরপুর উপজেলার শেখমাটিয়া ইউনিয়েনের বাকসি গ্রামে। সুকুমার মৃধার বাবা রাজেন্দ্রনাথ মৃধা একজন চৌকিদার ছিলেন। আটক পি কে হালদারের বান্ধবী অবন্তিকা বড়াল ওরফে কেয়ার গ্রামের বাড়ি নাজিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের আমতলা গ্রামে। পিরোজপুর শহরের খুমুরিয়া এলাকায় তাদের একটি বাড়ি রয়েছে। অবন্তিকার বাবা ছিলেন পিরোজপুর সরকারী সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রভাষক প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা অরুণ কুমার বড়াল।

দীঘিরজান এলাকাবাসীর সাথে আলাপ করে জানা গেছে, প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) বাবা মৃত প্রণবেন্দু হালদার দীঘিরজান বাজারের একজন দর্জি। মা লীলাবতি হালদার ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। প্রশান্ত কুমার হালদার ১৯৮২ সালে দীঘিরজান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। এরপর পাশর্^বর্তী বাগেরহাটের সরকারি পিসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর বুয়েটের মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের জুট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। ১৫-১৬ বছর আগে ভিন্ন ধর্মের এক নারীকে বিয়ে করার পর থেকে পি কে হালদার গ্রামছাড়া। তার এই অর্থপাচারের কেলেঙ্কারী ফাঁস হওয়ার পর শিক্ষিকা মা আরেক ছেলে প্রীতিশ হালদারের বাড়ি ভারতের অশোকনগরে চলে গেছেন। পিকে হালদারের আরেক ভাই প্রানেশ হালদারও কানাডায় অবস্থান করছেন বলে এলাকা থেকে জানা গেছে।

দীঘিরজান গ্রামে তার একজন প্রতিবেশী কলেজ শিক্ষক অধ্যক্ষ দীপ্তেন মজুমদার জানান, প্রশান্ত হালদারকে একজন মেধাবী ছাত্র বলে এলাকাবাসী চিনত। দীর্ঘদিন ধরে এলাকার সঙ্গে তার তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না । মানুষ জানত প্রকৌশলী পেশায় তিনি অনেক বড় চাকরি করেন। ১৫-১৬ বছর আগে এক মুসলিম নারীকে বিয়ে করেছেন বলে গ্রামে প্রচার রয়েছে। তার জীবনযাপন রহস্যজনক বা ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে বিয়ে করায় তিনি ধর্মত্যাগী হয়েছেন এরকম খবর ছিল। কুষ্টিয়ায় একটি জুট মিলসহ তার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা ছিল বলে মানুষ জানে। অঙ্গন হালদার নামে নিজ গ্রামের জনৈক ব্যক্তি ম্যানেজার হিসেবে পি কে হালদারের ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করেন। দীঘিরজান গ্রামে মা লীলাবতীর নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন পিকে হালদার, তারও তত্ত্বাবধায়ক অঙ্গণ হালদার। বর্তমানে পি কে হালদারের গ্রামের বাড়িতে পুরানো একটি কাঠের টিনশেড ঘর আছে, যেখানে তার চাচাতো ভাই দীপেন্দ্র নাথ হালদার বসবাস ও দেখাশুনা করে।

দীঘিরজান গ্রামে ওই বাড়িতে গেলে পি কে হালদারের চাচাতো ভাই দীপেন্দ্র নাথ হালদার , ভাইর ছেলে দ্বীপ হালদার, ভাইর মেয়ে স্মৃতি হালদার জানান, তারা এই বাড়ি দেখেশুনে রাখছেন। কিন্তু প্রশান্ত (পিকে) বা তার ভাইরা কেউই তাদেও কোন খোজ খবর রাখেন না। তারা জানান, পিকে হালদারের এই কেলেঙ্কারির খবর শোনার পর তারাও অনেক ভয় ও শংকার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

গতকাল শনিবার ভারতে পিকে হালদারের গ্রেফতারের খবরে পিরোজপুরের নাজিরপুর এলাকায় তার নিকটজনের মধ্যে নতুন করে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্যের।

এদিকে তার আয়কর উপদেষ্টা বলে এলাকায় পরিচিত ও প্রধান সহযোগী সুকুমার মৃধা ছিলেন একই উপজেলার বাকসি গ্রামের চৌকিদার রাজেন্দ্রনাথ মৃধার ছেলে। বিগত ‘ওয়ান ইলেভেন’ এর সময় থেকে নিজ গ্রাম নাজিরপুর, পিরোজপুর ও খুলনায় একজন দানশীল, শিক্ষানুরাগী, সংবাদপত্রসেবীসহ নানা নামে তার খ্যাতি ছড়াতে থাকে। পেশাগত জীবনে তিনি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, খুলনার রূপসা কলেজের অধ্যক্ষসহ একাধিক চাকরি করেন এবং এসব প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্নীতির দায়ে চাকরি হারান বলে জানা যায়। নিজ গ্রাম বাকসিতে রাজলক্ষ্মী ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে সরকারি খাস জমিতে মহাবিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি মন্দির, দুঃস্থ ছাত্রীনিবাস, বৃদ্ধাশ্রম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া এলাকায় অনেক মসজিদ ও মাদ্রাসা তিনি তৈরি করেছেন বলে তার প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার সুভাষ চন্দ্র মণ্ডল দাবি করেছেন।

সুকুমার মৃধার খুলনায় ‘আলোকিত বাংলাদেশ’ নামে অধুনালুপ্ত একটি সংবাদপত্রও ছিল । পার্শ্ববর্তী বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার আন্ধারমানিক গ্রামে ৫০ বিঘা জমিতে একটি হরিণের খামার গড়ে বন আইন লঙ্ঘন করে হরিণ বিক্রি ও মহলবিশেষকে ম্যানেজ করতে হরিণের মাংস ভেট দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে সুকুমারের বিরুদ্ধে। তিনি পি কে হালদারের দেহরক্ষীর সঙ্গে নিজ মেয়ে অনিন্দিতার বিয়ে দিয়েছেন। তার বোন মঞ্জু রানীর দুই ছেলে স্বপন মিস্ত্রি ও উত্তম মিস্ত্রিও পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী। এই দুজনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে দুদক তাদের দেশের বাইরে যেতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও স্বপন ইতোমধ্যে ভারতে ও উত্তম নিরুদ্দেশ রয়েছেন।

স্থানীয়ভাবে অভিযোগ পাওয়া যায়, পি কে হালদার মাঝে মাঝে সুকুমারের বাকসির রাজলক্ষ্মী ফাউন্ডেশনের গেস্টহাউজে মেয়ে বান্ধবীসহ রাত যাপন করতেন। দুই বোন, তাদের ছেলে ও স্বামীদের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় সুকুমার তাদের পরিচয় দেন না বলে আত্মীয়স্বজনের আক্ষেপ রয়েছে। সুকুমারের স্ত্রী ঢাকায় সোনালী ব্যাংকে চাকরি করেন।

দুদকের হাতে আটক পি কে হালদারের সহযোগী কাম বান্ধবী অবন্তিকা বড়াল ওরফে কেয়ার গ্রামের বাড়ি নাজিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের আমতলা গ্রামে হলেও পিরোজপুর শহরের খুমুরিয়া এলাকায়ও তাদের একটি বাড়ি রয়েছে। অবন্তিকার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা অরুণ কুমার বড়াল ছিলেন সরকারী কলেজের প্রভাষক। অবন্তিকা বড়াল ও তার অপর দুই ছোট বোন খুমুরিয় এলাকার বাসায় থেকে লেখাপড়া করেছে। পরে বাবা মারা যাওয়ার পরে এবং এখানকার লেখাপড়ার পাঠ শেষ করে অবন্তিকা ঢাকায় গিয়ে লেখাপড়া শুরু করে।

জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীর ধানমন্ডির ১০/এ সাত মসজিদ রোডে দামী ফ্ল্যাট রয়েছে অবন্তিকার। কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ওই ফ্ল্যাটে তার বিধবা মা অর্পনা বড়াল ও অন্য দুই বোন বসবাস করছে। অবন্তিকা গ্রেফতার হওয়ার কয়েক দিন আগে তার মা অপর্না বড়াল পিরোজপুরের বাড়িতে এসেছিল। দুই তিন দিন থাকার পরেই হঠাৎ করে আবার ঢাকায় চলে যান তিনি। জানা গেছে, অপর্ণা বড়াল পিরোজপুরে এসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি ঘর বরাদ্দ পাওয়ার জন্য দৌঁড়ঝাপ করেছেন।

উল্লেখ্য, পিকে হালদার আটকের আগে তার বেশ কয়েকজন সহযোগী ঢাকায় দুদকের মামলায় কারাগারে রয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাও রয়েছেন পিকে হালদারের নেটওয়ার্কে।

 
Electronic Paper