টাকার মেশিন
বিশ্বজিৎ দাস
🕐 ২:৪০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৯, ২০২১
‘আজ থেকে আমার একমাত্র টিউশনিটা বন্ধ হয়ে গেল রে।’ বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেয়ালে টিকটিকি দেখতে দেখতে আকাশ বলল।
‘দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছিস বুঝি?’ সুমন বলল।
বিছানায় আধশোয়া হয়ে মোবাইল ফোন টেপাটেপি করছে সে। দুজনে একই মেসে থাকে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। আর কয়েকদিন পর শুরু হবে কঠোর লকডাউন। এই লকডাউনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে চারদিকে। মেসের প্রায় সবাই নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। আকাশ যাকে প্রাইভেট পড়ায়, তার অভিভাবক বেশ ভালো আর আন্তরিক।
কয়েকদিন আগেও ডেকে বলেছিলেন, ‘তুমি সাবধানে থাকবে আর নিয়মিত পড়াতে আসবে।’
কিন্তু আজ বললেন উল্টো কথা।
‘যে হারে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে; তুমি বরং কয়েকদিন প্রাইভেট পড়ানো বন্ধই রাখ।’
‘এখন কী করবি?’ মোবাইল ফোন স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়ে জানতে চাইল সুমন।
‘ভাবছি আমিও বাড়ি চলে যাব।’ বিষণ্ন স্বরে বলল আকাশ।
‘আরে, তুই চলে গেলে আমার ব্যবসার কী হবে?’ সুমন বলল।
‘তোর আমের ব্যবসায় আমার কী কাজ?’
কলেজ বন্ধ হওয়ার পর থেকেই সুমন অনলাইনে টুকটাক ব্যবসা করছে। কখনো চাল, কখনো আম ইত্যাদি কুরিয়ার করছে দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে। প্রতিদিন।
‘আমের ব্যবসার সিজন তো শেষ। এখন অন্য কিছুর ব্যবসা করব ভাবছি।’ সুমন বলল।
‘কীসের ব্যবসা?’
‘স্টক বিজনেস।’
‘আরে ধুর! ওসব আলু, পটল, মরিচের স্টক করে লস খাবি। তাছাড়া তুই থাকিস মেসে। স্টক রাখার জন্য দরকার গোডাউন। সেটা কই পাবি?’ আকাশ বলল।
‘আরে ওসব নয়। আমি স্টক করব মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যÑ চিনি, চা, দুধ, সাবান, টুথপেস্ট এগুলো।’
‘এগুলো স্টক করে বিক্রি করবি কীভাবে?’
‘ফেসবুক পেজ খুলে। এখন মানুষ অনলাইনেই কেনাকাটা করছে। মাত্র দুই লাখ টাকা যদি ইনভেস্ট করতে পারি; দেখবি সাত দিনের লকডাউনেই একলাখ টাকা লাভ করব।’
‘কীভাবে?’
‘আরে বেশিরভাগ মাল কিনব সুপারশপে। ওখানে অনেক সাবান, পেস্ট ইত্যাদি একটা দুটো কিনলে আরেকটা ফ্রি পাওয়া যায়। বুঝতেই পারছিস, ফ্রি আছে এমন মালগুলোই আমাদের পেজে আপলোড করব বেশি বেশি।’
‘আর এত মাল কিনে রাখবি কোথায়?’
‘কেন! এই মেসে কিনে রাখব। সব এখানেই রাখব আর সারাদিন মেসে শুয়ে-বসে ফেসবুকে পেজের প্রচারণা চালাব।’
‘আর অর্ডার এলে?’
‘তুই বা আমি গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসব।’
‘সবই বুঝলাম। দুই লাখ টাকা তুই কোথায় পাবি? এত টাকা কি আছে?’
‘আমার এক খালাত ভাই আছে- শাহীন ভাই। তার আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। ব্যবসায়ী মানুষ। তার কাছ থেকে টাকা ধার নেব। চাইলে না করবে না।’
দুই.
‘এটা কি শাহীন ভাইয়ের নিজের বাসা?’ জানতে চাইল আকাশ।
ওরা দুজনে এসেছে সুমনের খালাত ভাইয়ের বাসায়। বেশ সুন্দর দোতলা বাসা। বাসার সামনে বাগান। সেখানে অনেক ফুলের গাছ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বাগানে বেশ যত্ন করা হয়।
‘বললি না, এটা কি শাহীন ভাইয়ের নিজের বাসা?’
‘আরে নাহ্। ব্যবসায়ী মানুষ। বাসা করলে অনেক টাকা ইনভেস্ট হবে। রিটার্ন আসবে না। তাই শাহীন ভাই বাসা ভাড়া করে থাকতেই পছন্দ করেন।’
‘বুঝতে পারছি।’ মুচকি হাসল আকাশ।
‘কী বুঝলি?’
‘তোরা আসলেই ব্যবসায়ী ফ্যামিলি। সবকিছুতেই আগে ব্যবসা খুঁজে দেখিস।’
কলিংবেল বাজাতেই কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল।
‘শাহীন ভাই আছেন?’
‘আছে। ভাইজান তো গোসল করছেন। আপনারা বসেন।’
ড্রইংরুমে টিভি চলছে। সোফায় বসে ছোট্ট একটি ছেলে টিভি দেখছে।
‘বাবু, তোমার নাম কী?’ আকাশ জানতে চাইল।
‘আমার নাম সামনে দিয়ে লিখলেও যা হবে; উল্টো দিকে লিখলেও একই হবে- বলুন আমার নাম কী?’ ছেলেটি চটপট জবাব দিল।
‘ওরে বাবা। এটা তো কঠিন প্রশ্ন। তুই পারবি সুমন?’
আকাশ কৃত্রিমভাবে আঁতকে উঠল।
‘রমাকান্ত কামার। ওর নাম নিশ্চয়ই রমাকান্ত কামার।’ হাসতে হাসতে বলল সুমন।
‘হলো না। আমার নাম নয়ন।’
‘বাহ্! খুব সুন্দর নাম। তোমার আব্বুর নাম কী?
‘আব্বুর নাম মো. শাহীন হোসেন।’
‘তোমার আব্বুর বুঝি অনেক টাকা?’ আকাশ ফস করে জানতে চাইল।
‘হ্যাঁ। আব্বুর কাছে অনেক টাকা আছে। একটা টাকার মেশিন আছে আব্বুর কাছে। যখন প্রয়োজন হয় আব্বু সুইচ টিপলেই টাকা বের হয়ে আসে।’ শিশুটি হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলল।
‘তাহলে তো তোমাদের অনেক টাকা। আমাদেরও কিছু দিতে বলো না।’
‘আপনারা আব্বুর কাছে চাইবেন, দেবে?’ নয়ন টিভিতে চোখ রেখেই বলল।
‘আমারও মনে হয়, শাহীন ভাইয়ের কাছে কোনো জাদুকরী মেশিন না থেকে পারেই না। এত টাকা আসে কোথা থেকে?’ ফিসফিস করে বলল সুমন।
‘জাল টাকা বানানোর মেশিন নয় তো?’ ফিসফিস করেই জানতে চাইল আকাশ।
সুমন উত্তর দেওয়ার আগেই ঘরে ঢুকলেন শাহীন ভাই।
‘সুমন, কী খবর? হঠাৎ সাতসকালে!’
‘একটা দরকারে এসেছিলাম।’
‘বাবা, ভিতরে যাও।’ নয়নকে ভিতরে পাঠালেন শাহীন ভাই।
‘কী দরকার বল?’
‘কিছু টাকার দরকার। ব্যবসার জন্য।’
‘ব্যবসা? কী ব্যবসা?’
খুলে বলল সুমন।
শুনে হাসলেন শাহীন।
‘সত্যি তোর মাথায় ব্যবসায়িক বুদ্ধি আছে বটে!’
শুনে আশান্বিত হয়ে উঠল সুমন।
‘দেবেন ভাই? দিন দশেক পরেই আপনাকে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিতে পারব।’
‘সে তো জানি। কিন্তু আমার কাছে এখন অত টাকা নেই রে। করোনার প্রভাব আমার ব্যবসাতেও পড়েছে। অনেকের কাছে পাওনা টাকা ঠিকমতো পাচ্ছি না।’
‘কী যে বলেন ভাই, আপনার মতন টাকার মেশিন যদি এই কথা বলে, তাহলে আমাদের মতন গরিব মানুষ কোথায় যাবে?’
‘আপনার নাকি টাকার মেশিন আছে? সুইচ টিপলেই টাকা বের হয়?’ কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসল আকাশ।
‘কে বলেছে?’ গম্ভীর হয়ে গেলেন শাহীন।
‘নয়ন বলেছে ভাই। এমনি বলেছে ভাই। বাচ্চা মানুষ। কী বলতে কী বলেছে।’
পরিবেশটাকে হালকা করতে চাইল সুমন।
‘আমি ভাবছি নয়ন হঠাৎ টাকার মেশিনের কথা বলল কেন?’ বিড়বিড় করে বললেন শাহীন।
‘বাদ দ্যান তো ভাই।’
‘নয়ন ঠিক কী বলেছে?’
খুলে বলল সুমন।
হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন শাহীন। মুখ চাওয়াচাওয়ি করল ওরা দুজন। ব্যাপার কী?
‘এবার বুঝেছি, নয়ন কী বলেছে। এটিএম মেশিন থেকে টাকা তুলি, নয়ন ওটাকেই মনে করেছে টাকার মেশিন। আর আমাদের কারখানার গেটেই তো একটা এটিএম মেশিনের বুথ আছে। তাই মনে করেছে ওই এটিএম মেশিনটা আমাদের!’
জোরে জোরে হাসতে থাকলেন শাহীন।
ওরাও হাসল।
শুকনো হাসি।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228