কোপা ও ইউরো কোলা
সাইফুল ইসলাম জুয়েল
🕐 ৩:৩১ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৩, ২০২১
‘কোপা শামসু কোপা।’ সাতসকালে পাশের বাসা থেকে গুপ্তদার চিৎকার কানে এলো। বাদল দিনে কাঁথা মুড়িয়ে আমার সাধের ঘুমের তেরটা বাজল তাতে। শুয়ে-শুয়েই গলা চড়িয়ে জানতে চাইলাম, ‘কী করছ গো, গুপ্তদা?’
‘সকালের রোজকার কাজ...।’
আড়মোড়া দিয়ে বিছানা থেকে উঠে দেখি গুপ্তদা তাদের বাসার বারান্দায় বসে চায়ের কাপ সামনে রেখে খবরের কাগজ পড়ছে। খবরের কাগজ পাঠ, সঙ্গে ঠা-া চাÑ এটাই তার প্রাতঃরাশ! এতেই নাকি পেট ভরে যায় তার। আলাদা করে আর নাস্তা খেতে হয় না।
জানতে চাইলাম, ‘কী হয়েছে, তখন ওভাবে চিক্কুর পারছিলে কেন?’ ‘কোপা শামসু কোপা।’ কথাটা আবারও বলল সে। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘কী মজা! সবাই মিলে আমেরিকাকে কোপাচ্ছে!’
‘আমেরিকাকে কোপাচ্ছে! মানে?’
গুপ্তদা তখন পত্রিকার খেলার পাতাটা বের করল। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। কোথাও কোপা শামসু বা আমেরিকাকে কোপানোর কথা বলা হয়নি। জীবনে কখনো খেলার খবর না পড়া গুপ্তদা আজ কী মনে করে ওই পাতাটা চোখের সামনে ধরেছিল কে জানে! তবে, সব দেখে-টেখে মনে হলো- কোপা আমেরিকা নামক যে ফুটবল টুর্নামেন্ট চলছে, ভুলক্রমে সেটাকে ‘আমেরিকাকে কোপাচ্ছে’ বলে ধরে নিয়েছে সে। আসলে, মোড়ল দেশ আমেরিকাকে একটু বাগে ফেলতে অনেকেই মুখিয়ে থাকে যে!
‘এখানে কেউ আমেরিকাকে কোপাচ্ছে না। আমেরিকা খেলছেও না। খেলছে ল্যাটিন আমেরিকার দশটি দেশ।’ আমি ভুলটা ধরিয়ে দিতেই গুপ্তদা দাঁতে জিব কেটে চুকচুক করে বলল, ‘আচ্ছা বাদ দে। চল, দুই ভাই মিলে ইউরো কোলা খেয়ে আসি। যদিও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ...।’
দুই.
‘হঠাৎ ইউরো কোলা কেন? তোমার না পেপসি পছন্দ?’
‘চয়েস বদলে ফেলেছি।’ ইউরো কোলা খেতে খেতে গুপ্তদা বলল। ‘শুনলাম ইউরোপের বাঘা বাঘা দেশ নাকি ইউরো কোলার পেছনে ছুটছে...।’ ওটা যে ইউরো কোলা নয়, ইউরো কাপ, আমি আর সেই ভুল ধরিয়ে দিতে গেলাম না। তৃপ্তি সহকারে কোলার বোতলে চুমুক দিলাম। ‘ইউরোপেই এত চাহিদা। এই দেশে এখনো বাতাস লাগে নাই। তবে লাগতে কতক্ষণ! পরে যদি না পাই...।’ গুপ্তদা পুরো এক কেস ইউরো কোলা কিনে বাসার পথ ধরল।
তিন.
ক’দিন পরে দেখলাম- গুপ্তদা তার কেনা সেই ইউরোর বোতলগুলো ফেরত দিচ্ছে। বদলে দোকান থেকে কোকাকোলা চেয়ে নিচ্ছে সে।
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম, ‘কী হলো গুপ্তদা, ইউরোপের লোকজনের রুচি বদলে গেছে বুঝি!’
গুপ্তদা শ্লেষমাখা কণ্ঠে বলল, ‘কিছুই জানিস না দেখছি! এত ব্যাক ডেটেড হলে কি চলে! রোনালদোর ভিডিওটা দেখিসনি?’
‘কোন রোনালদো?’
‘আরে, রোনালদো তো একজনই। বেরাজিলের। টাকু মাথার রোনালদো।’
‘ওহহ। কী করেছে সে?’
‘বুঝলি, বুড়োটা তো এখনো ফুটবল খেলে। আমি ফুটবল ছেড়ে দিয়ে কী ভুলই না করেছি...। ওদিকে দেখ, রোনালদো ফুটবল খেলার দরুন দিনকে দিন কী সুন্দর আর জোয়ান হচ্ছে। টাক মাথায় কী সুন্দর চুলও গজিয়েছে।’
আমি আর বলতে গেলাম না- রোনালদো টেকো ছিল না। গ্যারেথ বেল থুড়ি ‘বেল ছাট’ দেওয়া যে রোনালদোকে এদেশের মানুষ দেখেছে, ওটাই ছিল তার হেয়ার স্টাইল। আর সেই রোনালদো নাজারিও প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছে সেই কবে! এখন বিশ^ মাতাচ্ছে আরেক রোনালদো।
গুপ্তদা বলল, ‘ভিডিওটা ভাইরাল হয়ে গেছে বুঝলি। সেদিন কে জানি দেখাল। কী একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিল রোনালদো। সেখানে গিয়ে সামনে থেকে কোকাকোলার বোতল লুকিয়ে রাখল। আর সবার মনোযোগ কাড়তে পানির বোতলটা তুলে ধরল।’
এবার ইউরো’য় পর্তুগাল-হাঙ্গেরি ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে পর্তুগিজ অধিনায়ক ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ভাইরাল হওয়া ভিডিওটা আমিও দেখেছি। কিন্তু, এটা বুঝতে পারলাম না- যেই কোকের বোতল রোনালদো সরিয়ে রেখে সবাইকে পানি খেতে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছে, গুপ্তদা কেন সেই কোকের বোতলেই মুখ লাগাচ্ছে!
গুপ্তদা যেন আমার মনের কথাটা পড়তে পারল। বলল, ‘রোনালদো ওই কোকের বোতল দুটি কেন লুকিয়েছিল জানিস? বাসায় নিয়ে যেতে। চিন্তা করে দেখ, কোক কতটা ভালো হলে রোনালদোর মতো প্লেয়ারও তা ‘ফাও’ পেয়ে গোপনে বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদেরও জন্য নিয়ে যেতে চাইবে!’
গুপ্তদা’র এই কথার প্রত্যুত্তরে আমার তব্দা খাওয়া মুখে আর কোনো কথাই ফুটল না।
চার.
এবার একই সময়ে কোপা আমেরিকা ও ইউরো ফুটবল প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ায় পাড়া-মহল্লায় মোটামুটি একটা বিশ^কাপ-বিশ^কাপ আমেজ বিরাজ করছে। তার ওপরে ‘কঠোর লকডাউনে’ কারওরই পরদিন সকালে ক্লাস বা পরীক্ষার ঝামেলা নেই। ছেলে-ছোকরার দল তাই সন্ধ্যা সাতটায় সেই যে খেলা দেখতে বসে, ওঠে সকাল আটটায়। ততদিনে গুপ্তদাও কিছুটা হালহকিকত বুঝে উঠেছে। সেও স্রোতে গা ভাসাল।
একদিন জানতে চাইলাম, ‘কোন দলকে সাপোর্ট করছ?’
‘কোপায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা।’
‘একই সঙ্গে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ! এমন কেন?’
‘বা রে, জেনে-বুঝে পচানি কেন খাব! আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই এই দুই দলের সমর্থক। মওকা পেলেই একদল আরেকদলকে বেশ পচায়। আমি দুই দলেরই সমর্থক বলে পচানি থেকে জোর বাঁচা বেঁচে যাব যে!’
‘বুঝলাম। আর ইউরোপে?
‘যাদের সাপোর্ট করতাম, ওরা বাদ পড়ে গেছে- উত্তর মেসিডোনিয়া ও পর্তুগাল।’
‘এখানেও দুটি দেশ! তা, এখানেও কি ‘পচানি’র মতো বিশেষ কোনো কারণ আছে?’ ‘তেমন কিছু না। আসলে মেসির নাম শুনে শুনে ‘উত্তর মেসিডোনিয়া’র ভক্ত হয়েছি। মেসির নামে একটা দেশ! বিরাট ব্যাপার না? আর বেরাজিলের রোনালদোর সঙ্গে নামের মিল থাকায় পর্তুগালের রোনালদোর দেশকেও সমর্থন দিচ্ছি।’
পাঁচ.
স্থানীয় উদ্যোগে ফুটবল টুর্নামেন্ট চলছে। দেশে বেশিরভাগ ফুটবল টুর্নামেন্টই চলে বর্ষাকালে। হাঁটুসমান পানি আর প্যাঁক কাদার ভিতরে একটা বলের পেছনে গোলরক্ষক বাদে উভয়দলের বিশজনই দৌড়ে মরে!
গুপ্তদার সঙ্গে খেলা দেখতে গিয়ে একসময় বললাম, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি- ফুটবল বিশ্বকাপ জুন-জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হয়। তখন আবার এদেশে বর্ষার মরশুম। বিশ্বকাপ জ্বরে এদেশের ছেলে-পেলেরাও সিজন ভুলে খেলতে নেমে যায়। কয়েক বছর আগে (২০১১ সালে) বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বকাপ প্রাক-বাছাইয়ের খেলায় মাঠে বৃষ্টির পানি জমে কাদা-পানিতে মাখামাখি অবস্থা হয়েছিল। আমাদের খেলোয়াড়রা সেদিন খুব ভালো খেলেছিল। ম্যাচটাও ৩-০ গোলে জিতেছিল। সেদিন বাংলাদেশ আরও বড় ব্যবধানেও জিততে পারত।’
খবরটায় গুপ্তদা যেন খুবই উচ্ছ্বসিত। বলল, ‘বিশ্বকাপ খেলাটা এই বর্ষাকালে না হয়ে শীতকালে অনুষ্ঠিত হলেই তো পারে!’ আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘সামনে কাতার বিশ্বকাপ শীতকালেই হবে, ২০২২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে।’
‘যা, তাহলে এর পরের বিশ্বকাপটা আমাদের!’ গুপ্তদা নিজের হাঁটুতে কড়া থাবড়া মেরে বলল।
আমি আবারও তব্দা মেরে গেলাম। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন অনেক আগে (২০১২ সালে) বলেছিল, ‘বাংলাদেশ ২০২২ বিশ্বকাপ খেলবে।’ অথচ, এবার বাছাই পর্বে আমরা গ্রুপের পাঁচ দেশের মধ্যে তলানিতেই পড়ে রইলাম।
আর এখন গুপ্তদা চড়া আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল- বাংলাদেশ খোদ ২০২৬ বিশ্বকাপই জিতবে! ভেবে ভেবে কূল-কিনারাহারা আমি। গুপ্তদা আবার কোনোভাবে সামনের বাফুফের নির্বাচনে সভাপতি পদে দাঁড়াবে না তো!
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228