মির্জা য়াযাদের ভবন কেস সমাধান
বিশ্বজিৎ দাস
🕐 ১২:৪৪ অপরাহ্ণ, জুন ০১, ২০২১
‘স্যার, আপনার কি কিছু লাগবে?’ মিষ্টি কণ্ঠে ফোনের ওপাশ থেকে জানতে চাইল।
উত্তরা, ঢাকা।
ধীরে ধীরে এক চোখ খুলল মির্জা য়াযাদ ওমর।
বাংলাদেশ ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস- বিআইএস-এর আন্ডাররেটেড এজেন্ট। গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-বিদেশ। সরকারি টাকায়।
বিয়ে করেনি। কারণ কোনো মেয়ে ওকে বিয়ে করতে রাজিই হয়নি। সবাই ভেবেছিল, এজেন্ট হিসেবে মির্জা চিতাবাঘের মতন ক্ষিপ্রতা দেখাবে। কিন্তু পর পর অনেকগুলো মিশনের ব্যর্থতা তাকে নতুন খেতাব জুটিয়ে দিয়েছে- মিয়াও।
এ নামেই আড়ালে আবডালে সবাই ওকে সম্বোধন করে।
‘স্যার, আপনার কি কিছু লাগবে?’ সুকণ্ঠী আবার জানতে চাইল।
সারারাত ফেসবুক আর মেসেজিং করে ভোররাতে ঘুমিয়েছে মিয়াও। অনেক কষ্টে ঘুম জড়ানো এক চোখ খুলল ও।
সকাল দশটা।
বিরক্ত হলো মির্জা।
‘আপনি কে? কোত্থেকে বলছেন?’
‘যা চান তাই পাবেন।’ সুকণ্ঠী বলল।
‘মানে!’ আরেকটু হলেই বিছানা থেকে পড়ে যাচ্ছিল মির্জা।
‘জ্বি স্যার। যা চান তাই পাবেনÑ হোম ডেলিভারি সার্ভিস থেকে বলছি। যা চাইবেন তাই পৌঁছে দেব আমরা আপনার বাসায়।’
বিরক্ত মুখে লাইন কেটে দিল মির্জা। একটু পরই আবার বাজাল ফোন।
ধরল না মির্জা।
আবার বাজল ফোন। রেগেমেগে ফোন ধরল ও।
‘আমার কিছু লাগবে না খালাম্মা। মাফ করেন।’ ব্যঙ্গ করে বলল মির্জা।
‘মিয়াও, তুমি হুঁশ করে কথা বলছ তো?’ ওপাশ থেকে হুংকার করে উঠলেন কাবেরী মণ্ডল। বিআইএসের প্রধান- ওর বস।
আরেকটু হলেই মোবাইল হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল। কোনোমতে পিছলে পড়া ঠেকিয়ে বিছানায় উঠে বসল মির্জা।
‘জি... জি... স্যার। হোম সার্ভিসের লোক মনে করেছিলাম স্যার। খুব বিরক্ত করে আজকাল ওরা।’
‘হোম সার্ভিস নাকি পাওনাদার?’
ছয় মাস ধরে বেতন বন্ধ হয়ে আছে সব এজেন্টের। বাড়ি ভাড়ার অভাবে সেফ হাউসে থাকছে মির্জা।
‘না, ম্যাডাম।’
‘শোনো, তোমার জন্য নতুন মিশন ঠিক করেছি।’
অমনি তলপেট মোচড় দিয়ে উঠল মির্জার। মিশনের কথা শুনলেই টয়লেট যাওয়ার বেগ ওঠে ওর।
‘উহ!’ অস্ফুটে শব্দ বের হলো ওর মুখ থেকে।
‘মিয়াও, কী করছ তুমি?’ ধমক দিলেন বস।
‘জি ম্যাডাম, বলুন কোন দেশে মিশনে যেতে হবে?’
মিশন মানেই সরকারি টাকায় ভ্রমণ, ক্যাসিনোতে জুয়া, চারপাশে সুন্দরী ললনা- কল্পনায় দেখতে পেল মির্জা।
‘কোনো দেশেই তোমাকে যেতে হবে না।’
ওর আগ্রহে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিলেন বস।
‘তাহলে?’
‘শোন, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী স্বয়ং এসেছিলেন আমার অফিসে। তিনি খুব বিপদে পড়েছেন।’
‘কেমন বিপদ ম্যাডাম? কেউ কি উনার সন্তানকে কিডন্যাপ করেছে?’
‘না শুনেই অত কথা বল কেন মিয়াও?’ ধমক দিলেন বস।
বিড়ালের মতোই মিইয়ে গেল মির্জা।
‘আগারগাঁওয়ে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে নতুন ডাক আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভবন বানানো হয়েছে। মুশকিল হচ্ছে জিপিও আর পুরনো ভবন ছেড়ে নতুন ভবনে যেতে চাইছে না অফিসগুলো। মন্ত্রী পড়েছেন দোটানায়। একদিকে তার অধীনস্থ অফিসকে যেতে বলতেও পারছেন না। তাতে যদি ওরা ক্ষেপে যায়। আবার প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেও বারবার জানতে চাওয়া হচ্ছেÑ কেন ওরা যাচ্ছে না?’
‘আমাকে কী করতে হবে ম্যাডাম?’
‘তুমি নেট ঘেটে বুদ্ধি বের কর। দেখ অন্য দেশে এমন সমস্যা পড়লে তারা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে। এমন বুদ্ধি বের কর যেন সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। বুঝেছ! সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট আমার চাই-ই চাই।’
দুই.
‘না, না আমি কিছু বুঝতে চাই না ইউর অনার। সমাধান আমাকে দিতেই হবে। প্লিজ আমার প্রতি একটু সদয় হোন।’ কাকুতি মিনতি করে বলল মির্জা।
ঘুম ভেঙে গেল ওর। ঘামে ভিজে চুপচুপ করছে সারা শরীর। বিছানা ভিজে গেছে। সাতদিনের আজ শেষদিন। এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান বের করতে পারেনি ও। পারবে কীভাবে!
নেট কিনবে সে টাকাও পকেটে নেই। হ্যাকিং করে পাশের ফ্ল্যাটের ওয়াইফাই ব্যবহার করছিল, আজ ক’দিন ধরে সেটাও বন্ধ। ওই ফ্ল্যাটে চুরি হয়েছে। চোরের দল রাউটার পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। ফলাফল মির্জার তদন্তের ওখানেই পরিসমাপ্ত।
মোবাইল ফোনে নেট কেনার জন্য পরিচিত এক দোকানে ফোন করেছিল ও।
‘ভাই, আমি তো আগে থেকেই আপনার কাছে দু’হাজার টাকা পাই। আগে সেটা দিয়ে দেন।’
শালার কপালটাই খারাপ!
নেট নেই!
বেতন নেই!
অফিস নেই!
তার আবার মিশন!
দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল।
বিরক্ত মুখে দরজা খুলল মির্জা।
‘স্যার আপনার কি কোনো পার্সেল বা ডকুমেন্ট কুরিয়ার করবেন?’
‘আপনি কে?’
‘স্যার, আমি হলাম পাঠিয়ে দিই কুরিয়ার সার্ভিসের সার্ভিসম্যান। আমার কাজ হচ্ছেÑ বাড়ি বা অফিস থেকে সরাসরি চিঠি বা ডকুমেন্ট কালেক্ট করে অফিসে পৌঁছে দেওয়া। এর জন্য আপনাকে কোনো বাড়তি চার্জ দিতে হবে না।’
‘বলেন কী! কুরিয়ার এত বদলে গেছে!’
‘জি স্যার। এটাই স্যার স্মার্ট যুগের চাহিদা। প্রয়োজন মানুষের কাছে হেঁটে আসবে। মানুষ যাবে না।’
‘স্ট্রেঞ্জ! আমার কাছে তো ডকুমেন্টই নেই। আপনি কি আমাকে নয় টাকার এমবি প্যাকেজ দিতে পারবেন?’
‘স্যার, এটার জন্য আপনাকে মোড়ের রিচার্জের দোকানে যেতে হবে। সব জিনিস আপনার কাছে পায়ে হেঁটে আসবে না। বাই।’
চলে গেল ছেলেটি।
পাঁচ মিনিট পর মির্জাও ঘর থেকে বের হলো। ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।
বিছানার নিচে জমানো খুচরা পয়সা নিয়ে বের হয়েছে। বেতন ছাড়া এভাবে ক’দিন চলবে কে জানে?
নেট কেনার পর মির্জা পাউরুটি কিনতে গেল। দোকানদার ছেলেটির নাম নজরুল। ওকে দেখেই একগাল হেসে বলল, ‘মামা আপনি কষ্ট কইর্যা আইলেন ক্যান। আমারে ফোন দিয়েন, আমি গিয়া সওদাপাতি দিয়া আসতাম।’
‘কেন? তোমার দোকানে আমি আসি, তুমি চাও না?’
‘মামা, এরে কয় হোম ডেলিভারি সার্ভিস। মানুষ এখন আর দোকানে আইতে চায় না। ঘরে বইস্যা থাইক্যা ডেলিভারি চায়। সেজন্য হোম ডেলিভারি চালু করছি মামা। আপনার কী কী লাগব কইয়েন, দিয়া আমুনে।’
‘তোমাকে এই বুদ্ধিকে দিয়েছে? তোমার বউ?’ হেসে জানতে চাইল।
‘মামা, এখনো বিয়া করি নাই। আর বুদ্ধিটা পাইছি জগের কাছে।’
‘জগের কাছে?’
‘হ মামা। এক রাইতে পানির পিপাসা পাইছে। মনটা চাইতেছিল, কেউ গেলাসে কইরা পানি আইন্যা দেউক। কেউ নাই। শেষে আমিই উঠলাম। জগের কাছে গেলাম। গেলাসে পানি ঢাললাম। খাইলাম। বুইঝ্যা গেলাম হোম সার্ভিসের মাজেজা। খরিদ্দার আমাগো পাশে আইব না। আমাগোরে যাইতে হইব খরিদ্দারের কাছে। মালও বিক্রি হইব। খরিদ্দারও হাতছাড়া হইব না।’
ফেরার পথে মাথা হ্যাং হয়ে থাকল মির্জার। বারবার মাথায় বাজতে লাগল নজরুলের কথা, ‘জগ আমাগো কাছে আইব না। আমাগোরে জগের কাছে যাইতে হইব।’
সেদিন অফিস আওয়ারের একেবারে শেষ মুহূর্তে রিপোর্টটা ই-মেইল করল মির্জা।
লিখল, ‘যুগ পাল্টে গেছে। যুগের সঙ্গে পাল্টাতে হবে আমাদের অফিস আদালতকেও। তাই ডাক আর কম্পিউটার ভবনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীরা যেতে না চাইতেই পারেন। তাদের চাওয়ার প্রতি সম্মান জানিয়ে ভবন দুটিকেই নিয়ে যেতে হবে অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছে। বলা চলে, তাদের কাছে ভবনগুলো হোম ডেলিভারি দিতে হবে। এখন ভবনগুলোর গোড়ায় চাকা ফিট করে কীভাবে সহজে তাড়াতাড়ি স্থানান্তর করা যায়, সে বিষয়ে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করাই হবে এই সমস্যার সেরা সমাধান।’
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228