ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাবু, মিষ্টি খাইছ!

আবুল কালাম আজাদ
🕐 ২:৩৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৭, ২০২১

বাবু, মিষ্টি খাইছ!

মারুফ বিছানায় শুয়ে আছে উপুড় হয়ে। সে উপুড় হয়ে শোয়া মানে গভীর ঘুমে থাকা।
মারুফের সেলফোনটাও পাশে ঘুমাচ্ছে। যতক্ষণ ওটার বুকে আঙুলের স্পর্শ না চলে ততক্ষণ ওটার ঘুম।
হঠাৎ সেলফোনটা জেগে উঠল। বাজতে শুরু করল। বেজেই চলছে। উপুড় হওয়া ঘুমের সময় সেলফোনের শব্দ মারুফকে জাগাতে পারে না।

মারুফের মা রাশিদা বেগম এলেন। ফোনের স্ক্রিনে তাকালেন। সেখানে লেখাÑ সুইট লিটল বেবি। লিটল বেবি তো সুইট হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো লিটল বেবি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মারুফকে ফোন করবে কেন?
রাশিদা বেগম ফোন রিসিভ করলেন। ওদিক থেকে বলল : সোনা বাবুটা আমার, ঘুমাচ্ছিলে বুঝি? তোমার ঘুম ভেঙে দেওয়ার জন্য আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি।
রাশিদা বেগম বললেন : আপা, আমি বাবুর মা।
: স্লামালিকুম খালাম্মা, স্লামালিকুম...।
: আমার ছেলে যদি আপনার সোনা বাবু হয়, আমি খালাম্মা হই কোন হিসেবে?
: খালাম্মা, আমি শুভ্রা। মারুফের সাথে এক কলেজে পড়তাম।
রাশিদা বেগম মারুফকে ধাক্কা দিয়ে বললেন : এই তোর সুইট লিটল বেবি ফোন করেছে।
মারুফ ধরফড়িয়ে উঠে বসল। রাশিদা বেগম চোখে-মুখে চরম বিরক্তি ফুটিয়ে ফোন ফেলে চলে গেলেন। মারুফ ফোন কানে নিল। বলল : ফোনটা কে রিসিভ করেছে তা না শুনেই তুমি হড়বড় করে কথা বলতে শুরু করে দাও। তোমাকে অনেকবার বলেছি, এইসব আহ্লাদি ডাকাডাকি আমাকে করবে না।
: সোনা বাবু আমার, এখন অত কিছু শোনার টাইম নাই।
: সমস্যা কী?
: তুমি একটা ভ্যানগাড়ি নিয়ে জীবন চাঁদের মিষ্টির দোকানে আসো। সব জানতে পারবে।
: ভ্যানগাড়ি নিয়ে! ভ্যানগাড়ি নিয়ে কেন? রিকশা নিয়ে আসি?
: আরে নাহ, রিকশায় চলবে না! জলদি ভ্যানগাড়ি নিয়ে আসো।
শুভ্রা ফোন কেটে দিল। মারুফের আবার বিছানায় লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল। চোখভরা ঘুম। কিন্তু ঘুমানো যাবে না। ভ্যানগাড়ি নিয়ে জীবন চাঁদের মিষ্টির দোকানে যেতে হবে। সে হয়তো সেখানে বসে মিষ্টি খাবে, তারপর ভ্যানগাড়িতে চড়ে ঘুরবে। এ মেয়ের দ্বারা সবই সম্ভব। না হলে এ যুগে কেউ চারবার এইচএসসি ফেল করে?
নিচে নেমে মারুফ দেখে আশপাশে কোনো ভ্যানগাড়ি নেই। থাকার কথাও না। গেটের বাইরে ডানপাশে কিছু রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। মারুফ দারোয়ানকে বলল : একটা ভ্যানগাড়ির ব্যবস্থা করা যায়?
দারোয়ান আঙুল তুলে বলল : ওই যে একটা ভ্যানগাড়ি।
মারুফ দেখে রিকশাগুলোর পেছনে দোকানের সামনে একটা ভ্যানগাড়ি দাঁড় করানো। ফ্ল্যাট ও নিচু বলে সহজে চোখে পড়ে না। ভ্যানগাড়ির কাছে গিয়ে মারুফ চালককে পেল।
জীবন চাঁদের দোকানের সামনে গিয়ে মারুফ দেখে শুভ্রা দুধ-সাদা পোশাক পরে শুভ্র পরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা সত্যিই খুব সুন্দর। চেহারার ভেতর আশ্চর্য রকম সারল্য। সরল ও বোকা বোকা হওয়ার কারণেই হয়ত শুভ্রা এতটা সুন্দর হয়েছে।
মারুফকে দেখেই শুভ্রা চিৎকার করে উঠল : এতক্ষণ লাগল?
: কই, বেশি সময় লাগেনি তো।
: বেশি সময় লাগেনি?
: ভ্যানগাড়ি পাচ্ছিলাম না।
: ঢাকা শহরে ভ্যানগাড়ির অভাব? শোয়া থেকে উঠতে পারছিলেন না তাই বলো। আমি এখন ভার্সিটি স্টুডেন্ট। আমার সাথে হিসাব করে কথা বলবে।
বিগত চার বছর ধরে শুভ্রা বলে এসেছে, আমি কলেজ স্টুডেন্ট, এখন হঠাৎ বলছে, আমি ভার্সিটি স্টুডেন্ট। ঘটনা কী? এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অটোপাস দেওয়ার কথা আছে। রেজাল্ট কি হয়ে গেছে? রেজাল্ট হলেও তো এখন ভার্সিটি স্টুডেন্ট হবার কথা না। মারুফ হতভম্ব ভাব নিয়ে তকিয়ে রইল শুভ্রার মুখে। শুভ্রা বলল : অমন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছো কেন? আজ আমার রেজাল্ট বের হয়েছে জানো না? আমি এ মাইনাস পেয়েছি। দু’দিন পরে ভার্সিটিতে চলে যাব।
: ও, তা ভ্যানগাড়ি কেন?
: চার মণ মিষ্টি কি তুমি মাথায় করে নেবে?
: চার মণ! এত কেন?
: চার বারের পরে পাস করলাম। প্রতিবারে এক মণ করে হলে...।
: তুমি একা? সাথে আর কেউ নেই?
: বাবা বুথ থেকে টাকা তুলতে গেছে।
শুভ্রা মনের মতো একটা বাপ পেয়েছে। মেয়ের আবদার তিনি রক্ষা করবেনই। এতদিনের প্রেম। যদিও অনেক বাধা আছে তবুও সে নিশ্চত, একদিন শুভ্রাকে সে বিয়ে করবে। তাদের যদি একটা মেয়ে হয়, মেয়েটা যদি শুভ্রার মতো সহজ-সরল, ন্যাকামো টাইপের হয় তো সেও কি শুভ্রার বাবার মতোই মেয়ের আহ্লাদকে প্রশ্রয় দেবে? এরকম প্রশ্ন মারুফের মনে প্রায়ই জাগে। তার মাঝে মাঝে মনে হয়, নাহ! এরকম ন্যাকামি সে প্রশ্রয় দেবে না। সে সংসার ছেড়ে বনে চলে যাবে। ধ্যান করে সিদ্ধার্থ হবে। আবার ভাবে, না মেয়েটাকে ফেলে এক মুহূর্তও সে কোথাও থাকতে পারবে না।
শুভ্রার বাবা এলেন। মিষ্টির দাম মিটিয়ে দিলেন। ভ্যানগাড়িতে চার মন মিষ্টি তোলা হলো। শুভ্রা আর মারুফ বসল ভ্যানগাড়ির সামনে দুই পাশে, শুভ্রার বাবা বসলেন পেছনে। শুভ্রা ভ্যানগাড়ির চালককে বলল : ভাই, উঁচু-নিচু দেখে চালাবেন। ঝাঁকিতে মিষ্টি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ভ্যানগাড়ি চলছিল খুবই আস্তে, ঠিক হাঁটার গতিতে। হঠাৎ শুভ্রা বলল : আমার কপালটাই খারাপ!
কণ্ঠে ভীষণ আফসোস। মারুফ ঝট করে তাকাল শুভ্রার মুখে। চার মণ মিষ্টি কিনছে অথচ বলছে কপাল খারাপ। শুভ্রা বলল : পরীক্ষা হলে আমি নিশ্চিত এ-প্লাস পেতাম। এখন এ-মাইনাস নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
মারুফ বলল : তুমি শিওর যে এ-প্লাস পেতে?
: শিওর না তো কী? এবার যে ফাটাফাটি প্রিপারেশন ছিল, তাই না বাবা?
শুভ্রার বাবা মাথা নেড়ে বোঝালেন, ঠিক তাই। শুভ্রা বলল : বাবা, আমি এখন ভার্সিটি স্টুডেন্ট। আমাকে একটা বাইক কিনে দিতে হবে।
বাবা বললেন : অবশ্যই দিব।
শুভ্রা বাইক কিনলে তার পেছনে নিশ্চয় মারুফকে কখনো না কখনো চড়তে হবে। এই কথা ভেবে মারুফের শরীর দিয়ে ঘাম বের হয়ে গেল।
শুভ্রা একটা মিষ্টির প্যাকেট খুলে ফেলল। বাবার দিকে একটা স্পঞ্জ রসগোল্লা বাড়িয়ে দিয়ে বলল : বাবা, একটা খেয়ে দেখো তো, আসল জিনিস দিয়েছে কি না। ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করতে নেই।
বাবা সুবোধ বালকের মতো হাত বাড়িয়ে মিষ্টিটা নিলেন। মারুফ বলল : আঙ্কেল, আপনার তো ডায়াবেটিস আছে।
শুভ্রা ধমক দিয়ে উঠল : তুমি চুপ করো। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টের মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিসে কোনো সমস্যা হয় না। বাবা, খাওয়ার সময় মনে করবে, তোমার মেয়ে এ-প্লাস পেয়েছে।
বাবা রসগোল্লাটা মুখের ভেতর চালান করে দিলেন। শুভ্র বলল : ভ্যানওয়ালা ভাই, হা করেন।
ভ্যানচালক হা করল। শুভ্রা তার হা-র ভিতর একটা রসগোল্লা ঢুকিয়ে দিল। মারুফ মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ছিল যাতে তাকে হা করতে না বলা হয়। দোয়া-দরুদে কাজ হলো। শুভ্রা মারুফকে মিষ্টি খেতে বলল না।
ভ্যানগাড়ি শুভ্রাদের বাসার গেটে এসে থামল। শুভ্রার তত্ত্বাবধানে ভ্যানগাড়ি চালক কয়েকটা করে প্যাকেট নিয়ে বাসায় রেখে আসছে।
রাস্তার এক পাশে মারুফ দাঁড়িয়ে, একটু দূরে শুভ্রার বাবা। মিষ্টি নেওয়া শেষ হলে তিনি গাড়িচালককে ভাড়া দেবেন। তারপর তিনিও বাসায় ঢুকে যাবেন। মারুফ ফিরে আসবে বাসায়। এই আনন্দমুখর দিনেও শুভ্রাদের বাসায় মারুফের যাওয়া হবে না। শুভ্রা প্রথম যেবার এইচএসসি ফেল করল সেবারই শুভ্রার মা মারুফকে কঠিনভাবে শাসিয়ে দিয়েছেন : তোর সাথে প্রেম করতে গিয়ে আমার মেয়ে ফেল করেছে, তুই কোনোদিন আমার সামনে আসবি না। তুই স্বার্থপর। তুই সেলফিস। তুই লেখাপড়া থেকে আমার মেয়ের মন তুলে দিয়ে নিজে ঠিকই লেখাপড়া করেছিস। মনে রাখিস, আমি ভ্যানচালকের সাথে মেয়ে বিয়ে দেব তবু তোর সাথে দেব না।
একপর্যায়ে শুভ্রার বাবা মারুফের পাশে এসে দাঁড়ালেন। মারুফের কাঁধে হাত রেখে বললেন : আমার মেয়েটা সহজ-সরল, বোকাসোকাও বলা যায়। লেখাপড়ায় সেরকম মন নেই। খলবল করে কথা বলে। প্রজাপ্রতির মতো উড়ে উড়ে চলে। কিন্তু ও আমার জীবন। ও আমার সুখ এবং আনন্দ। ওকে ছাড়া আমার পৃথিবী আমি কল্পনা করতে পারি না। অটোপাস নিয়ে অনেকের উপহাস আছে- উন্নাসিকতা আছে। কিন্তু আমার তা নেই। ঝুঁকির মধ্যে পরীক্ষা হলে আমার মেয়েটার যদি কিছু হতো তো যা হওয়ার আমারই হতো, আর কারও কিছু হতো না। বাবা-মা ছাড়া আর কার কী হয় বলো?
শুভ্রা এল। ওর হাতে চার প্যাকেট মিষ্টি। মারুফের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল : এটা নিয়ে বাসায় যাও।
: এত মিষ্টি কেন?
: চার বছরের চার কেজি।
: এত লাগবে না। এক প্যাকেট দাও।
: বেশি কথা বলবে না তো। নিয়ে যাও বলছি।
মারুফ মিষ্টি নিয়ে বাসায় এল। ডাইনিং টেবিলে মিষ্টির প্যাকেটগুলো রেখে নিজের ঘরে গেল। ঘুমের ভাবটা এখনও আছে। ঘুম দিতে হবে। ঘুম না দিলে রাতে লেখাপড়া করা সম্ভব হবে না। দু’দিন পর একটা টিউটোরিয়াল এক্সাম আছে। মারুফ বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। তার উপুড় হতে খুব বেশি সময় লাগল না।
মারুফের ফোন বেজে চলেছে। উপুড় হওয়া ঘুম ভাঙবে না। মারুফের মা এলেন। সেই সুইট লিটল বেবি। তিনি কল রিসিভ করলেন। সুইট লিটল বেবি বলল : বাবু, মিষ্টি খাইছ?
: না আপা, বাবু মিষ্টি খায় নাই, উপুড় হয়া ঘুমাইতেছে।
ধপ করে ফোন কেটে গেল।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper