উদ্ধার
হাফিজ উদ্দীন আহমদ
🕐 ১:৩৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৩, ২০২১
ছেলেটা সেভেনে, মেয়েটা এইটে। দুই সন্তানকে নিয়ে মোটামুটি আনন্দেই দিন কাটে রজব আলী ও তার স্ত্রীর। কিন্তু ছেলেমেয়েদের খুব কড়া শাসনে রাখেন। পড়াশোনা ফাঁকি দেওয়া একদম পছন্দ করেন না। রজব আলী অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের সন্তান। মানুষের ঘরে জায়গীর থেকে খুব কষ্টে সৃষ্টে লেখাপড়া করে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সেদিন পড়ার টেবিলে দেখলেন ছেলে লেখাপড়া ছেড়ে রঙতুলি নিয়ে মনের আনন্দে ছবি আঁকছে। অমনি তিনি গিয়ে তার কান চেপে ধরলেন।
: এখন কি ছবি আঁকার সময়? আজ কি তোর ড্রইং ক্লাস আছে?
কর্তব্যপরায়ণ বাবা ছেলের ক্লাস রুটিনের সব খবর রাখেন।
: না, বাবা।
: তাহলে ছবি আঁকছিস কেন?
: বাংলা স্যার প্রশ্ন লিখে বাড়ির কাজ দিয়েছেন। আজকেই করে নিতে হবে।
: দেখি!
খাতাটা টেনে প্রশ্নটা দেখলেন তিনি। লেখক সুন্দরবন ভ্রমণ প্রবন্ধে বনের যে নৈসর্গিক বর্ণনা দিয়েছেন তার চিত্র ফুটিয়ে তোলো।
: ব্যাটা গাধা, তোকে ছবি আঁকতে বলেনি। লেখার মাধ্যমে বনের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে বলেছেন।
তিনি আর দাঁড়াবার সময় পেলেন না। অফিসের টাইম হয়ে গেছে। এই ছেলেই তার ভবিষ্যৎ। ছেলের প্রতি আরও খেয়াল রাখতে হবে ভাবতে ভাবতে তিনি চলে গেলেন। বড় বোন রূপা দূর থেকে ছোট ভাই রবির দুরবস্থা দেখছিল। তার মনটা পিঠাপিঠি এ ভাইয়ের জন্য করুণায় উথলে উঠল। পরদিন আবার রবির পড়ার টেবিলে হাজির হলেন রজব। চোখে পড়ল ছেলে মনে মনে কী যেন পড়ছে। পড়া ফাঁকি দিয়ে গল্পের বই নয়ত? তিনি জানেন তার ছেলে গোয়েন্দা উপন্যাসের পোকা।
: কী বই পড়ছিস?
: ট্রান্সলেশন।
আশ্বস্ত হলেন তিনি তবু একটু বাজিয়ে দেখতে হবে ওর লেখাপড়া। বইয়ের যে পাতাটি পড়ছিল তার প্রথম ট্রান্সলেশনটাই জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
: ইংরেজী করÑ তার ভবিষ্যৎ খারাপ।
জানা প্রশ্ন ধরায় ছেলে খুব খুশি হয়ে বললÑ হিজ ফুটুরি ইজ ডার্ক।
: তোর ফুটুরিই ডার্ক ফাঁকিবাজ।
বলে ঠাস করে চড় মারলেন একটা গালে।
তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বললেন এফ ইউ টি ইউ আর ই ফুটুরি নয় রে ফিউচার। সবসময় চেঁচিয়ে পড়বি আমি যাতে শুনতে পাই।
আর কথা বাড়ালেন না। চলে যেতে উদ্যত হলেন। স্ত্রী তাহমিনা দেখতে পেয়ে বললেন, তুমি খালি ছেলেকে শাসন করো আর মেয়েকে মাথায় তুলে রেখেছ।
তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে কড়া সুরে বললেন, তুমিও সাবধান হয়ে যাও। ড্রইং রুমে বান্ধবীরা তো বটেই মাঝে মাঝে দু-একটা ছেলেও আসে। তুই সবসময় ওদের সঙ্গে নিচু স্বরে ফুসুরফাসুর করে কথা বলিস। তা আর করা যাবে না। কারও সঙ্গে লাইন মারিস কি-না যাতে বুঝতে পারি।
শেষ বাক্যটা মুখে এসে গেলেও কোত করে গিলে ফেললেন তিনি। প্রকাশ্যে বললেন, সব কথা জোরে জোরে বলবি আমি যাতে রান্নাঘর থেকে শুনতে পাই।
: সব কথা জোরে জোরে বলতে হবে?
: হ্যাঁ, সব কথা।
তাহমিনা বিরক্ত হয়ে জবাব দিলেন। দু’ভাইবোনেরই মন খারাপ। এ নিগ্রহ থেকে উত্তরণ পেতে হবে। কিন্তু কীভাবে উদ্ধার পাওয়া যায় ভেবে কূল কিনারা পায় না তারা। পরদিন সকাল থেকে দুজনেই চেঁচিয়ে পড়তে লাগল। ওদের পড়া শুনে খুশি মনে রজব আলী অফিসে চলে গেলেন। একটু পরেই রূপার গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। বুয়া কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। তারপরও তার কানের কাছে চেঁচিয়ে বলল সেÑ এক কাপ চা এনে দাও।
আচমকা বাজখাই কণ্ঠে বুয়া ভিমরি খেয়ে পড়তে পড়তে টেবিল ধরে নিজেকে সামলে নিল।
: আফা, চা খাইবেন ভালা কথা। এমুন ধমকাইয়া কথা কন ক্যা?
: ধমকালাম কোথায়? মা জোরে কথা বলতে বলেছে।
বাবা অফিসে চলে যেতেই রবি অংক শেষ করে স্বাস্থ্য বই খুলে আজকের পড়াটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়তে লাগলÑ বয়ঃসন্ধি : এ সময় বালকের গোঁফ ওঠে। ছেলেমেয়েদের মাঝে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। মেয়েদের কোমর মোটা হয়, স্তন বড় হয়।
আর পড়া হলো না। ভাতের মাড় গালছিলেন তাহমিনা রান্নাঘরে। তা ফেলে রেখে নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ! বলতে বলতে দৌড়ে ছুটে এলেন তিনি।
: কী সব নোংরা কথা পড়ছিস?
: মা, এগুলো বইতে লেখা আছে।
: ছি ছি ছি! তাই বলে কি চেঁচিয়ে পড়তে হবে? তুই মনে মনে পড়।
: আব্বাই তো কালকে কান মলে চড় দিয়েছে আস্তে পড়ছিলাম বলে।
: বেশ তোর আব্বাকে বুঝিয়ে বলব।
হঠাৎ চোখে পড়ল পড়ার টেবিলে রূপা নেই। মেয়েটা গেল কোথায়? আবার কারও সঙ্গে ফুসুরফাসুর করছে নাকি?
: রূপা, রূপা!
গলা চড়িয়ে ডাকতে লাগলেন তিনি।
: এই... যে... আমি!
কোথা থেকে যেন দূরাগত উত্তর এলো।
: তুই কোথায়? কী করছিস?
গলা আরও চড়িয়ে জানতে চাইলেন তিনি।
: আমি বাথরুমে। প্যাড বদলাচ্ছি।
ততোধিক চড়িয়ে উত্তর দিল রূপা।
: বেশরম মেয়ে! পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে জানান দিয়ে এ কাজ করতে হবে নাকি?
: তুমিই তো বলেছ মা সব কথা চেঁচিয়ে বলতে।
হায় কপাল! কী যে হয়েছে আজকালকার পোলাপানদের!
মা আপন মনে গজরগজর করতে চলে গেলেন।
পরদিন থেকে বাড়িতে পুরনো পরিবেশ ফেরত এলো।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228