লক যখন ডাউন হয়ে যায়...
পূর্ব প্রকাশিতের পর...
শফিক হাসান
🕐 ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২১
পাঁচ.
অর্থনৈতিক সংকটে দেশ- এমন কথা বিলকুল মিথ্যা প্রমাণিত হয় বাজারে এলে। ধনেপাতা-পুদিনাপাতার চাহিদা বেড়েছে অনেক। পানের দোকানেও লম্বা লাইন। লকডাউন কে মানে! বাজারভর্তি মানুষ। গিজগিজ করছে বঙ্গপাল হয়ে। বিরামহীন হইচই-হট্টগোল কান সইতে পারছে না। তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে সওদাপাতি খরিদ করা গেল। বাসায় ফিরে স্বস্তিতে সেগুলো রাখতেও পারলেন না। তার আগেই একমাত্র মেয়ে সানিয়া মোবাইল ফোন বাড়িয়ে দিল- ‘বাবা, মামা কথা বলবেন। লাইনে আছেন।’
ফোনের ঊর্ধ্বাংশ চাপা দিয়ে তিনি বলেন, ‘বলে দে, আমি বাসায় নেই। ডেঙ্গুজ্বরে মেডিকেলে ভর্তি আছি।’
ওড়নার প্রান্ত দিয়ে নাকে জমে ওঠা ঘাম মুছতে মুছতে সানিয়া বলল, ‘বলেছি তুমি বাসায় থাকো এখন। এর আগে মা জানিয়েছে, সুস্থ আছ!’
সদা সত্য কথা বলিবে জাতীয় বাক্য তিনি কখনই মেয়েকে শেখাননি। তবুও এমন হলো কেন কে জানে। স্ত্রী শিরিনও তার মতোই বাস্তববাদী, মিথ্যা বুদ্ধিসম্পন্না। অনিচ্ছার বিবমিষা নিয়ে মোকাব্বির ফোন কানে ঠেকান- ‘হ্যালো, খালেক! তোমাকে আমি একটু পরেই কল করতাম।’
‘সেই সময় কি আপনার আছে, দুলাভাই! কত ব্যস্ততা আপনার।’
‘এই তো চলছে, নুনে-আটায়।’
‘আমাদের তাও চলছে না। লকডাউন সব শাটডাউন করে দিয়েছে। আপনাকে যে পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলাম তিন বছর আগে, এবার যদি টাকাগুলো পরিশোধ করতেন, উপকার হতো। আপাকে বলেছি, সেও বলেছে দেবে।’ ‘পাওনা অবশ্যই পরিশোধ করা উচিত। মাথা হালকা হয়। কিন্তু...।’
‘দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে আসার দরকার নেই। বিকাশ করে দেন। আমার নম্বরটা পার্সোনাল।’
‘সবকিছুর বিকাশই তো রুদ্ধ হয়ে আছে। আমরা চাইলেও কি সবকিছু সহসা স্বাভাবিক করতে পারব। অর্থনীতির সব দরজাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কী জানো, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ও এখন বন্ধ! বিকাশ নামে যে শীর্ষ সন্ত্রাসী আছে, সেও নাকি ছাগল পালন করে দিন কাটাচ্ছে।’
‘বিকাশে সমস্যা হলে রকেটে দেন।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মোকাব্বির- ‘রকেটের গতিতেই তো দেশটা এগিয়ে যাচ্ছিল রে। একদিকে পদ্মা সেতু, অন্যদিকে মেট্রোরেল। আরও কত মেগা প্রজেক্টের কাজ এগিয়ে নিচ্ছিল চীনা কর্মকর্তারা। কিন্তু সর্বনাশা করোনা রকেট গতিকে এভাবে থামিয়ে দেবে- কেউ ভাবতে পারেনি কখনো!’
শ্যালক বাবু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ওপারে- ‘বুঝেছি, আপনি বিকাশে খর্বকায়, রকেটেও মন্থর গতি। তাহলে নগদে দেন। বাইরে গিয়ে তুলে নেব।’
‘বর্তমানে মৃত্যুটাই নগদ। বাকি সব শূন্য। এই তো গত পরশু পাশের বাসার কলেজপড়–য়া ছেলেটা মারা গেল। কী যে ভালো ছেলে ছিল; দেখা হলেই হাসি হাসি মুখ করে সালাম দিত। এমন নগদানগদি কারবার আর কোনো কালে দেখিনি।’
‘শিওরক্যাশ?’
‘সব ক্যাশ এখন যমদূতের হাতে। দেখছ না, কেমন টপাটপ করে মানুষগুলোকে নিজ মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেসব ভিআইপি আগে সর্দি-কাশি হলেই সিঙ্গাপুরে দৌড়াত তারা এখন বিমান দেখে ভয় পাচ্ছে। মারা যাচ্ছে আতঙ্কে। এখন শিওর বলতে মৃত্যুটাই...।’
থেমে গেলেন মোকাব্বির, ওই পাশ পুরোপুরি নিস্তব্ধ। খুশিই হলেন, খালেকের বোধহয় ব্যালেন্স শেষ! পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলার পর খেয়াল করলেন, শিরিন কখন যেন সামনে লাল চা রেখে গেছেন। করোনা ও গরমের প্রাদুর্ভাবে গরম চা ভীষণ উপাদেয়। চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবলেন, অ্যাড ফার্মগুলো হয়তো ভবিষ্যতে বিজ্ঞাপন বানাবে- গরমে ঘনঘন চা খান, আরও বেশি আরাম পান!
ছয়.
মোবাইল ফোন ক’দিন বন্ধ রাখলেন মোকাব্বির। স্থগিত করলেন বাইরে যাওয়াও। আশপাশের লোকজন জ্বালাচ্ছে ভীষণ। সবারই চাই চাই, নাই নাই রব। অথচ খোঁজ নিলে জানা যাবে, তার মতো অন্যদের বাসা-বাড়িতেও আনন্দমেলা; খাদ্যসামগ্রীতে ভরপুর! এদিকে মেয়ে বায়না ধরেছে, তাকে স্মার্টফোন কিনে দিতে হবে। স্ত্রী বলছে তাকে নতুন শাড়ি কিনে দিতে। শপিংমল চালু হয়ে গেছে। করোনামুক্ত পরিবেশে বিক্রি হচ্ছে দেশি-বিদেশি পোশাক, গয়নাগাটি। কসমেটিক্স। এই সুযোগ শুধু করোনাকালের জন্য। দামও সাশ্রয়ী। মেয়ের ঘ্যানর ঘ্যানর, স্ত্রীর ছিঁচকাঁদুনে মহড়ার মধ্যেই এলো বাড়িওয়ালার গঞ্জনাজনক বার্তা- চলতি মাসেই সমুদয় ভাড়া পরিশোধ করতে হবে! মোকাব্বির সবাইকে আশ্বাস দেন, চেষ্টা চলছে। একপর্যায়ে মাথায় দুষ্টবুদ্ধি খেললে কল করেন অফিসে। বেতন বাবদ কিছু টাকা অগ্রিম চান। ওই পাশে তার শীর্ষ বস আকাশ থেকে পড়লেন যেন। ধপাস শব্দ শুনতে পান মোকাব্বির। বস নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘দেখুন মোকাব্বির সাহেব, অফিস বন্ধ। তারপরও আমরা মানবিক কারণে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বাসায় বেতন পাঠিয়ে দিচ্ছি মাসে মাসে। এরপরও আপনার আর কী চাহিদা থাকতে পারে! মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, পিপিই লাগবে?’
চলবে...
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228