ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

লকডাউনের গল্প

মাহবুবুল আলম মাসুদ
🕐 ২:০৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৬, ২০২১

লকডাউনের গল্প

দেয়ালের ধুলোয় বন্দি হয়ে বটবৃক্ষের বিচি যেমন একদিন চারা হয়ে ইতিউতি করতে থাকে, এই লকডাউনে বন্দি হয়ে বাজ মাহমুদের দাড়িও তেমন ইতিউতি করতে লাগল। ধানের বীজতলার মতো সেই দাড়ি, কোথাও উঁচু-নিচু নেই। সারাদিন একটু পরপর বাজ মাহমুদ তার বীজতলায় হাত বোলান আর আয়নায় তাকিয়ে থাকেন। মনে পড়ে যায় সুদূর শৈশবের স্মৃতি- যেন জালার (ধানের চারা) ডগায় জমে থাকা শিশিরের ওপর হাত বোলাচ্ছেন। ঘাড় ডানে ঘোরান, বামে ঘোরান; ভালোই লাগে তার।

স্ত্রী সাবেরা আড়চোখে দেখে মাঝেমাঝে টিপ্পনি কাটে- জঙ্গল কি পার্মানেন্ট হয়ে গেল নাকি, সাফসুফ হবে না? 

বাজ মাহমুদ হ্যাঁ-না কিছু বলেন না। আয়নায় স্ত্রীকে দেখে মুচকি মুচকি হাসেন।
ভালোলাগা নাকি বিলিয়ে দিতে হয়।
একদিন বাজ মাহমুদ মেয়েকে বললেন- মা, আমার একটা ছবি তুলে দে না।
মেয়ে খুব একটা গা করল না। বলল, আচ্ছা দেব।
কয়েকদিন পর আবার বললেন- মা রে, একটা ছবি তুলে দিবি?
: দেব।
: দে তাহলে।
: এখন! পরে দিই?
বাজ মাহমুদ বললেন, আচ্ছা।
সাবেরা বললেন, দে না একটা ছবি তুইলা। কয় দিন ধইরা কইতাছে।
: আইচ্ছা, বস। তুইলা দেই।
: ঘরেই?
: না তো কি। এখন কি বাইরে যাওয়ার সময়?
: না, চল ছাদে যাই।
: এই ভরদুপুরে? বিকেলে তোল, ছবি ভালো হবে।
: আচ্ছা।

বিকালে বাপ-বেটি ছাদে গেলেন ছবি তুলতে। কিন্তু ছবি পছন্দ হয় না। দোতলা বাড়ির ছাদের ছবিতে পেছনে খালি বড় বড় দালান ভেসে ওঠে। একটু আকাশ কিংবা গাছপালা হলে ভালো হতো।
ছাদের এক কোণে একটা ড্রামে ছিল একটা লেবু গাছ। আকামের গাছ। লেবু হয় না একটাও। মাঝে মাঝে পাতা ছিঁড়ে শুধু শাক-শুঁটকি রান্না হয়। কয় দিনের বৃষ্টিতে গাছটা বেশ যৌবন ফিরে পেয়েছে। পাতাগুলো যেন চেয়ে আছে।

চেয়ে থাকা পাতার ডাক শুনতে পেল মেয়ে। বলল, পাইছি। আব্বু, তুমি ওই গাছটার সামনে দাঁড়াও।
বাজ মাহমুদ গাছটার সামনে দাঁড়ালেন। মুচকি একটা হাসিও দিলেন। ছবি উঠে গেল।
সেই ছবি ছেড়ে দিলেন ফেসবুকে। ভালোলাগা বিলিয়ে দিতে হবে যে। মেয়েই ব্যবস্থা করল। তিনি এখনো এত কায়দা-কানুন জানেন না।
লাইক-কমেন্টের বন্যা বয়ে গেল।

যে বাজ মাহমুদ সাতটার বেশি লাইক পাননি কোনোদিন আর দুইটার বেশি কমেন্ট- তাও আবার একটা শালীর আরেকটা শত্রুবেশি বন্ধু অফিসকলিগ ইজাজের, সেই বাজ মাহমুদের ফেসবুক ভরে গেল লাইক-কমেন্টে। প্রথম দিনেই সেঞ্চুরি। দ্বিতীয় দিনে আবার হাফসেঞ্চুরি। ইজাজ এখানে তো কমেন্ট করবেই। লিখল- বুঝেছি, লকডাউনের দাড়ি, চলে যাবে তাড়াতাড়ি। একজন আবার লিখল, লুকিং গুড, কন্টিনিউ ইট।

ঈদের পরে লকডাউন উঠে গেল। অফিসে যেতে হবে। বৃদ্ধ, গর্ভবতীদের জন্য ছাড় আছে। কিন্তু অল্পের জন্য বৃদ্ধ হতে পারলেন না বাজ মাহমুদ। বৃদ্ধ হতে লাগে ৫০। তার আছে ৪৯। অবশ্য পঞ্চাশও পারই হয়ে গেছে তার কিন্তু কাগজে যে ৪৯। অফিস তো কাগজই দেখবে। তবে যে যা বলে বলুক- ‘লোকনিন্দা পুষ্প চন্দন’। জঙ্গল মুখেই অফিসে যাবেন।

অফিসে গিয়ে বাজ মাহমুদ দেখেন খাতায় সিগনেচারের সেই পুরনো দিন ফিরে এসেছে। ফিংগারিং বন্ধ। গুতাগুতির দিন আপাতত শেষ। চশমাটা ভালো করে ঘষে মুছে চোখে লাগিয়ে সাইন করতে গিয়ে চমকে গেলেন। সব ঘোলা। কিছুই দেখা যায় না। চোখে হঠাৎ কী সমস্যা হলো? পরে দেখেন সমস্যা চোখে নয়, চশমাতেই। মাস্ক পরার কারণে মোছা চশমা মুখের বাষ্পে ঘোলা হয়ে গেছে।
সাইন করে চেয়ারে বসতেই লোকনাথ বাবু এলেন- হুজুর হইয়া গেছেন দেখা যায়।
: হইলাম। রবীন্দ্রনাথ ‘হুজুর’ হইতে পারলে আমি হইতে দোষ কী?
: রবীন্দ্রনাথ ‘হুজুর’ আছিল নাকি?
: সে তো আপনি ভালো জানেন।
: না রে ভাই, লম্বা চুল রাখলেই কি কেউ বাউল হইয়া যায়?
: এই তো বুঝছেন।

লোকনাথ বাবু চলে গেলেন। অফিসে ঢুকলেন সেই শত্রুবেশি বন্ধু ইজাজ আহমেদ। পাশের টেবিলটাই তার। ইজাজের সঙ্গে সম্পর্কটা অফিস কলিগের চেয়েও খানিকটা বেশি। তুমি তুমিই চলে। ঢুকেই হৈহৈ করে উঠলেন, আরে চইলা যায় নাই দেখা যায়।
: কেমনে যাব, কন্টিনিউ ইটও আছিল।
: ঈদ কেমন করলা?
: ঈদ তো ভালোই হইল, ঝামেলা ছাড়াই ঈদ।
: বাচ্চাদের কাপড়চোপড় কিনছিলা?
: পাড়ার এক দর্জি দিয়া বাচ্চাদের মা’ই সামলাইছে।
: সেমাই খাইছ?
: সবই হইছে খালি একটা জিনিস বাকি রইছে।
: বাকি রাখলা কেন, টাকা-পয়সার টান পড়ছিল নাকি?
: নানা ওইটার জন্য টাকা লাগে না। তোমারে পাইলেই হইত।
: আমারে পাইলে কী হইত?
: কোলাকুলিটা হইত। ওইটাই তো বাকি আছে। আস কাজটা সাইরা ফেলি। বলে, বাজ মাহমুদ হাত বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গি করল।
ইজাজ আহমেদ সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে তিন হাত পিছিয়ে গিয়ে বললেন, তওবা, তওবা, এই করোনাকালে এইসব তুমি কী বল?
: কিছু হবে না, আস ঈদটা পূর্ণ করি। বলে, বাজ মাহমুদ হাসতে হাসতে বসে পড়লেন।
ইজাজ আহমেদও তার সিটে গিয়ে বসলেন। একটু পরেই আবার টেবিলে আঙুল দিয়ে ঠুকঠুক করতে করতে গাইতে লাগলেন, আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী...।
বাজ মাহমুদ বললেন, খুব মুডে আছ মনে হয়।
: মুডে না রে ভাই। আতঙ্কে আছি।
: আতঙ্কে কেউ গান গায়?
: এইডা তো আতঙ্কেরই গান। মুডে আছ তুমি। কাঁচাপাকা বাবু হয়ে গেছ।
: কাঁচাপাকা না পাকাকাঁচা। পাকাই বেশি।
: তাই তো দেখা যায়। মতলব কী? শ্বশুর হওয়ার প্রস্তুতি চলছে নাকি?
: আরে না, শ্বশুর দূর অস্ত। মেয়ে মাত্র নাইনে পড়ে। ছেলে তো এখনো বিছানায় পেশাব করাই ছাড়তে পারল না।
: তাহলে মতলবটা কী?
: কোনো মতলব নাই। মতলব তো চাঁদপুরে। একমুখ আর কত দেখমু। একই মুখ দেখতে আর ভালো লাগে না। তাই বিনা পয়সার প্লাস্টিক সার্জারি কইরা নিলাম।
ইজাজ আহমেদ হো হো করে হাসতে লাগল।
অফিস হলো নামকাওয়াস্তে। কাজকাম হলো না বললেই চলে। ছুটিও হয়ে গেল দুই ঘণ্টা আগেই।
অফিস থেকে নিচে নেমে বাজ মাহমুদ দেখেন অল্প বয়সী এক লোক বাঙ্গি নিয়ে বসে আছে। এই গরমে বাঙ্গির শরবত ভালোই লাগবে ভেবে এগিয়ে গেলেন।
: এই, বাঙ্গি কত কইরা?
: ষাইট টেহা।
: কও কী! আরে এই যে এই ছোটটা।
: ওইটা পঞ্চাশ টাকা দেন।
: এই বাঙ্গির দাম পঞ্চাশ, দশ-পনের কইরা বাঙ্গি বেঁচে। বিশ টাকায় দিবা?
: এই বাঙ্গির দাম বিশ টেহা! বালাই কইছেন।
: বিশ টাকায় দিলে দেও না দিলে না দেও।
: বিশ টেহায় বাঙ্গি না, এই বাঙ্গির বিচিও পাইবেন না।
: আচ্ছা। তুমি তোমার বিচি লইয়া বইসা থাক।
বাজ মাহমুদ হাঁটা শুরু করলেন। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই কানে এলো কথাটা, দাড়িঅলা মানুষই বালা না।
বাজ মাহমুদের ইচ্ছে হল ফিরে গিয়ে ওর গালে কষে একটা চড় লাগাতে কিন্তু নিজের টিঙটিঙে শরীরের দিকে চেয়ে বহু কষ্টে বিরত রইলেন।
রাতে চিৎ হয়ে ওপরের মশারির দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছেন বাজ মাহমুদ। বাঙ্গির ঘটনায় মনটা খারাপ। পাশে চিৎ হয়ে আছেন সাবেরাও। টের পেয়ে বললেন, কী হইছে?
: না, কিছু না।
: কিছু তো হইছে, কও।
: দাড়ি আর রাখতাম না। কাইলই ফালাইয়া দিমু।
: কেন?
: দাড়িঅলা মানুষ রে কেউ পাত্তা দিবার চায় না। সামান্য এক রাস্তার বাঙ্গিঅলা- সেও দাড়ি লইয়া খোঁটা দেয়।
: বাঙ্গিঅলার সঙ্গে ঝগড়া করছ?
: হ।
: ঝগড়া করছ ক্যান?
: ঝগড়া করমু না। বাঙ্গির দাম চাইল পঞ্চাশ, আমি কইলাম বিশ। আমারে কয় কি জান, এই দামে বাঙ্গির বিচিও পাইবেন না।
: তুমি কইষা একটা চড় মারলা না ক্যান?
: চাইছিলাম মারবার।
: মাইরাই দিতা। একটু পরেই আবার সাবেরা বললেন, না থাক, না মাইরা ভালোই করছ। রাস্তাঘাটে মারামারি ভালো না।
কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ শুয়ে থাকেন তারা। পাঁচ ওয়াটের হলুদ বাতিতে সব স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ বাজ মাহমুদ শোয়া থেকে উঠে বসেন। সাবেরা বলেন, কী হইল?
: পেটটা ব্যথা করছে।
: গ্যাস হয়েছে। তোমারে কত কই প্রতিদিন একটু কইরা আদা খাইবা। তুমি খাও না। পা টান কইরা লম্বা হইয়া শুইয়া থাক।
বাজ মাহমুদ তাই করলেন। সাবেরা পাশ ফিরে ডান হাতটা বাজ মাহমুদের পেটের ওপর রেখে মালিশ করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে সেই হাত ওপরে উঠে বাজ মাহমুদের গালে গিয়ে থামল। কিন্তু আঙুলগুলো থামল না। চলতে থাকল। ওপরে নিচে। সাবেরার গাঢ় কণ্ঠ ভেসে এলো, দাড়িতে তোমারে সুন্দরই লাগছে। রাইখা দাও।
বাজ মাহমুদের কণ্ঠও ভারী হয়ে এলো, সত্যি বলছ?
: তিন সত্যি করতে হবে নাকি?
: না না, তোমার এক সত্যিই তিন সত্যি।
সাবেরার আঙুল চলতেই থাকে। বাজ মাহমুদের মনে হয় জালার ডগার শিশিরবিন্দু ঝরে ঝরে পড়ছে।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper