ছবি বিভ্রাট
বিশ্বজিৎ দাস
🕐 ৪:০৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২২, ২০২০
পায়চারি করতে শুরু করল সেলিম। বিরক্ত মুখে। বারান্দায় গিয়ে বাইরে তাকাল। বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। একবার ভাবল, ছাতা নিয়ে চলে যাই। হেঁটেই আসি। পরক্ষণেই বাদ দিল চিন্তাটা। আকাশে বজ্র চমকাচ্ছে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কেন- নিজেকে জিজ্ঞেস করল সেলিম। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতেই চোখ গেল ফ্লাওয়ার ভাসের দিকে। মুহূর্তেই বুঝতে পারল কারণটা।
করোনার সময়টাতে প্রতিদিন সকালেই নিয়ম করে হাঁটতে বের হচ্ছে সেলিম। মাঝে মাঝে জনশূন্য রাস্তাঘাটের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেয়। কম হলেও অনেকে লাইক দেয়। সেলিমেরও সেদিন মনে হয়, কিছু একটা করলাম। আজ ফুলের ছবিই না হয় পোস্ট করি— ভাবল ও।
মোবাইল ফোন বের করে শুধু মেকি ফুলগুলোর ছবি তুলে পোস্ট করল সেলিম।
হঠাৎ করে খুশি খুশি লাগতে শুরু করল ওর। বুঝতে পারল, ফেসবুকে পোস্ট না করতে পারার জন্যই মনটা খুঁতখুঁত করছিল।
দুই.
নিখুঁত!
দারুণ!
এত সুন্দর ফটোগ্রাফি!
আপনার গাছের ফুল বুঝি?
ফেসবুকের কমেন্টগুলো পড়তে পড়তে কান্নাই পেল সেলিমের।
নিজেকে অপরাধীও মনে হলো।
ছবিগুলো ফুলেরই ছিল। অরিজিনাল ফুল নয়। আর্টিফিসিয়াল।
ফুলের ছবি সবাই পছন্দ করেÑ ভাবল ও। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফুলের ছবি দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। সেলিম ঠিক করল, এরপর থেকে হাঁটতে গেলে রাস্তাঘাটের ছবি আর পোস্ট করবে না। এই করোনাকালে শূন্য রাস্তাঘাট আর দালান দেখে কারোরই ভালো লাগার কথা নয়।
পরদিন সকালে হাঁটতে বের হলো সেলিম। চোখ রইল রাস্তার দু’পাশে। এত বড় শহরে রাস্তার ধারে ফুলের গাছ নেই!
বর্ষার কারণে রাস্তার পাশে জঙ্গলি গাছ জন্মেছে। খুঁজে খুঁজে সেসব গাছের ফুলের ছবি পোস্ট দিল ও।
দারুণ রেসপন্স পেল সেলিম। সে নিজেও ফুল আর গাছগুলোর নাম জানে না। এবার কমেন্ট পড়ে জানতে পারল।
—কুকুর মুতা গাছ।
—কাঁটালি বেগুনের ফুল।
—রসুনি শাকের গাছ।
—ধুতুরা, নেশার গাছ।
মনটা খারাপ হলো সেলিমের। শেষপর্যন্ত কিনা নেশাদ্রব্যের ফুলের ছবি দিচ্ছে ও ফেসবুকে। মানুষ কী ভাববে ওকে। পরদিন সকালে উঠে আরও অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটতে গেল সেলিম। ফেরার পথে চোখে পড়ল একটা একতলা বাসা। বারান্দায় অনেক ফুলের গাছ। বেশ লাগছে। ইতস্তত করল ও। তারপর মোবাইল ফোন বের করে ছবি তুলতে শুরু করল।
একটু পরই কলার ধরে পেছন থেকে টান দিল কেউ।
‘ব্যাপার কী? ছবি তুলছিস কেন?’ কর্কশ গলায় বলল যুবক।
‘আ... আমি আ... সলে ফুলের ছবি তুলছিলাম।’ তোতলাতে তোতলাতে বলল সেলিম।
‘হুমম। তুই যে চোর-ডাকাত দলের সদস্য না বুঝব কীভাবে?’
আপাদমস্তক ওকে মাপল যুবক।
কী বলবে ভেবে পেল না সেলিম।
তারপর হড়বড় করে বলল, ‘আমাকে কি আপনার চোর ডাকাত বলে মনে হচ্ছে? আমি একজন চাকরিজীবি। করোনাকালে প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হই। আর ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিই।’ হঠাৎ যেন কথা খুঁজে পেল সেলিম।
‘হুমম। দেখি ছবি।’ সেলিম ফেসবুক খুলে গত দিনের ছবিগুলো দেখাল।
‘সরি ভাই। আজকাল চেহারা দেখে বোঝা যায় না কে চোর আর কে ভালো মানুষ। ছবি তুলবেন তুলুন না। আমাকে সহ তুলুন। ফুলের ছবি তুলবেন আর মালিকের ছবি তুলবেন না, তাই হয় নাকি?’
তিন.
এভাবে হবে না।
দুদিন পরই বুঝতে পারল সেলিম ফেসবুকের পোস্ট করা ছবিগুলোতে লাইক পড়ছে আগের তুলনায় কম। কারণটাও বুঝতে পারছে। ফুলের ছবিগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য কম।
ঠিক করল, নতুন নতুন ফুলের ছবি তুলে আনবে। প্রয়োজনে সকালে আরও দূরে হেঁটে যাবে। তাই করল সেলিম। পরদিন অনেক দূর হেঁটে যাওয়ার পর একটা পুকুরে শাপলা ফুলের দেখা পেল ও। লাল লাল শাপলা একসঙ্গে অনেকগুলো করে ফুটেছে। মন ভরে ছবি তুলল সেলিম।
ফিরে এসে মোবাইল ফোন চেক করল ও। মোট দশ কিলোমিটার হেঁটেছে আজ। ফেসবুক পোস্ট করার পর সেই পোস্ট মেসেঞ্জারে সেন্ড করল কয়েকজনকে। ক্যাপশনে লিখল- ‘পাঁচ কিলোমিটার যাওয়া আর পাঁচ কিলোমিটার আসাÑ মোট দশ কিলোমিটার পথ হেঁটে হেঁটে এই ছবিগুলো তোমার জন্য তুলেছি। তবু কি তুমি লাইক দেবে না?’
একে একে মেসেঞ্জারে কয়েকজনকে পাঠাল।
ফিরতি জবাবে শৈশবের বান্ধবী ফারজানা লিখল, ‘দোস্ত ভালোই তুলেছিস। কিন্তু সত্যি করে বল, এই মেসেজ আর কয়টা মেয়েকে লিখেছিস?’
অফিসের সহকারী শারমিন লিখল, ‘বস, ছবিগুলো দারুণ হয়েছে। আমি তো ভাবতেই পারিনি, আপনি আমার জন্য এত কষ্ট করে ছবি তুলে আনবেন।’
আরিফ লিখল, ‘বস, শুনলাম আপনি নাকি সবার কাছে লাইক চেয়ে বেড়াচ্ছেন?’
এক্স প্রেমিকা লায়লা লিখল, ‘ছি ছি, তোমার এত অধঃপতন হয়েছে! সবার কাছে লাইক ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছ।’
থম মেরে ল্যাপটপের সামনে বসে রইল সেলিম। এভাবে ভাবেনি সে। সবার মন ভালো করতে চেয়েছিল। তাই প্রত্যেককেই লিখেছিল, তোমার জন্যই তো এত দূরে হেঁটে গেলাম আর এলাম।
বোঝাই যাচ্ছে, সবাইকে আপন মনে করলেও অন্য সবাই সেটা সহজভাবে নাও নিতে পারে।
হঠাৎ মনে পড়ল, সবচেয়ে আপনজনকেই তো মেসেজটি পাঠানো হয়নিÑ রাবুকে।
তাড়াতাড়ি লেখাগুলো কপি করে রাবুকে ফুলের ছবিগুলো মেসেঞ্জারে পাঠাল সেলিম।
পাশের ঘর থেকে রাবু জবাব পাঠাল সঙ্গে সঙ্গে।
‘আমার জন্য যাও, না অন্য কোনো মেয়েকে দেখতে প্রতিদিন পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে হেঁটে যাও, সেটা তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখতে হবে আগে। তারপর বুঝব, এই ছবি আসলে কার জন্য তুলেছ!’
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228