ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাঙ্কু কাকুর টিস্যুকাব্য

সৈয়দ আহসান কবীর
🕐 ২:৫৬ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৭, ২০২০

বাঙ্কু কাকু এখন অবসরে। হিসাব বিভাগের বড় কর্তা ছিলেন। অঙ্কের গরমিল ধরে দেওয়া তার কাছে ওয়ান-টুর ব্যাপার। গরমিল ধরতে ধরতেই এক সময় ধরে ফেলেন কাব্যের আসল শক্তি। বুঝে যান— আমলাদের খুশি করতে পামোময় কবিতা বেশ উপাদেয়। কবি হওয়ার ইচ্ছে জেগে ওঠে মনে। ভাবনা দোলা না দিলেও বিছাতে থাকেন শব্দের এলোমেলো জাল। ‘এক এককে এক, কলম খুলে দেখ। দুই এক কে দুই, বস-কে দিও রুই...’ জাতীয় বেশ কয়েকটি লেখাও লিখে ফেলেন। অধীনস্থদের ডেকে ডেকে পড়ে শোনান। বড়কর্তা বলে কথা। সবাই বাহ্বা দেন। লেখার অর্থ, ভাবার্থ না বুঝলেও পামিয়ে যান সমানে। লেখা পড়ে শোনানোর সময় অনেকে টেবিল চাপড়ে বেতালে তাল দিতে থাকেন। আর যায় কোথায়, বাঙ্কু কাকুর কলমের গতি বেগতিক বেগে দৌড়াতে থাকে। চাকরি থেকে অবসরের পর এ বেগ আরও বেড়েছে। তবে এখন বসদের জন্য লেখেন না, লেখেন সময় কাটানোর জন্য।

এই তো সেদিন বাঙ্কু সাহেবের মন আনন্দে গদগদ। হাতে একটি টিস্যু। তাতে লেখা— ‘আলো তার আলো কার অন্ধকার আলেয়ার বাসা/ মুখ তার মুখতার বাড়াবাড়ি ভাষা।’ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মনে মনে পড়ছিলেন। পাশের বাসার সালেক মিয়াকে আসতে দেখে থামতে বললেন। অনেকটা দৌড়েই নামলেন। জীর্ণ টিস্যুর ভাঁজ খুলে বললেন, ‘শুনুন মিয়া।’ তারপর শুনিয়ে দিলেন, ‘আলো তার আলো কার...।’ গোঁফে তা দিতে দিতে বললেন, ‘বলেন তো, জীবন বাবু কি আর পেরেছেন আমার মতন লিখতে?’ সালেক মিয়া জীবন বাবুকে চিনলেন না। ভ্রু কুঁচকে চেহারায় চেনা চেনা ভাব জাগিয়ে বললেন, ‘নাহ, তাও কি সম্ভব! এটা তো বাঙ্কু কাকা, সে গুড়ে জীবন ফাঁকা।’ শুনেই বাঙ্কু কাকু সেই রকম খুশি হলেন। বললেন, ‘খাড়ান, খাড়ান! দারুণ বললেন মাইরি। খাসা কবিতা হয়েছে। আমার সঙ্গে থেকে থেকে আপনিও তো মিয়া কবি বনে গেছেন।’ কোন বনে গেছেন বুঝলেন না সালেক মিয়া। তবে বাঙ্কু কাকু মুখে কবি খেতাব পেয়ে কবি-কবি ভাব মনে ভর করল। চোখ উদাস উদাস হয়ে উঠল। কোর্টের আলগা করে টাই টেনেটুনে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে শুরু করলেন। তারপর বাসার পথ ধরলেন। লেখাটা শেষ করতে হবে। রেশ ধরে রাখলেন, ‘এটা তো বাঙ্কু কাকা... এটা তো বাঙ্কু কাকা...।’

রসায়নের অধ্যাপক সালেক মিয়ার মধ্যে এত প্রতিভা লুকিয়ে ছিল, জানতেনই না তিনি। বাঙ্কু সাহেব আজ আবিষ্কার করে দিলেন। বাঙ্কু সাহেব যখন তাকে কবি বলেছেন, তখন তিনি কবি। তার বাসায় বড় বড় কবিরা আসেন। রাতভর ভুড়িভোজ চলে, সঙ্গে লালজল আড্ডা। সালেক মিয়াও গিয়েছেন বেশ ক’বার। লালজলে ঢোল হয়েও বাঙ্কু সাহেবের প্রশংসা করেন বরেণ্যরা। সেই বাঙ্কু সাহেব তাকে কবি বলেছেন।

অনেক কথা ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকলেন সালেক সাহেব। বউ অনিমা সালেক দৌড়ে এলেন। গায়ে-মাথায় হাত দিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন। এইমাত্র বাইরে গিয়ে মানুষটা ফের ফিরে এলেন। শরীর-টরীর খারাপ করলো কিনা! তারপর বললেন, ‘ঠিক যা ভেবেছিলাম। বারবার বললাম— এখন বাজারে গিয়ে কাজ নেই। শুনলেই না...’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ষাটোর্ধ্ব সালেক মিয়া ‘কিছুই হয়নি বউ, শরীরের এ গরম কাব্যের মৌ’ বলে আরও কী যেন বিড়বিড় করতে করতে পকেট থেকে কলম বের করে ছোট ঘরের দিকে এগোলেন। অনিমা সালেকের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। পাগল-টাগল হয়ে গেল কিনা ভেবে বাঙ্কু কাকুকে খবর দিলেন।

দুশ্চিন্তায় অনিমা সালেক যখন অস্থির, তখন সালেক মিয়া কোর্ট-টাই পরেই ছোটঘরে প্রকৃতির ডাকে বসে পড়লেন। তখনও তার মাথায় ঘুরছে, ‘এটা তো বাঙ্কু কাকা, এটা তো বাঙ্কু কাকা...’। বেশ খানেক পর ‘অনিমা অনিমা...’ ডাকতে ডাকতে বের হলেন। রান্নাঘরে না পেয়ে ঢুকলেন ড্রইংরুমে। সেখানে বাঙ্কু কাকুও বসা। চিন্তিত চেহারা। অনিমার কথা শুনছেন। সালেক মিয়ার হাতে তখন লম্বা টিস্যু পেপার।

বাঙ্কু কাকুকে দেখে ‘লিখে ফেলেছি, লিখে ফেলেছি’ বলে রীতিমতো হেলেদুলে পড়তে শুরু করলেন, ‘এটা তো বাঙ্কু কাকা, তা শুনে জীবন ফাঁকা। লিখতেন ফর্দ-হিসাব, জিততেন বিশ্ব রেকাব। অবসরে কাব্য করেন, সে সুরে কবিও ধরেন। দিয়ে দেন সনদ খেতাব, তুলে নেন লজ্জা-নেকাব, আমিও তারই পথে, লিখে যাই টিস্যুর রথে।’

সালেক মিয়ার হাতের টিস্যুতে লেখা কাব্য আবৃত্তি শুনে বাঙ্কু কাকুও পকেট থেকে একটি টিস্যুর ভাঁজ খুলতে শুরু করলেন।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper