বাসর রাতে বেড়াল মারা
হাফিজ উদ্দীন আহমদ
🕐 ১:৪২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১০, ২০২০
: শালার জীবনটাই ব্যর্থ। লেখালেখি করতে পারি বলে কত ক্লাসমেট তাদের প্রেমিকার কাছে আমাকে দিয়ে প্রেমপত্র লিখিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমিই আজ পর্যন্ত একটা প্রেম করতে পারলাম না। রুম মেট রাকিবকে কথাটা বলল আলিম।
: দোস্ত, প্রেম করতে টাকা লাগে। মেয়েদেরকে গিফট দিতে হয়। বার্থ ডে-তে বড় ফুলের তোড়া দিয়ে উইশ করতে হয়। রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে হয়। এমনিতেই মেয়েরা পটে না।
: আরে নিজেই খেতে পারি না, আবার মেয়েদের খাওয়াব? হোস্টেলের মিল চার্জটাও দিতে পারিনি। দরিদ্র বাবা ছোট একটা ব্যবসা করে যে ক’টাকা পাঠান তা মাস কাবার হওয়ার আগেই প্রায় শেষ হয়ে যায়। কয়েকদিন থেকে বাকিতে খাচ্ছি।
: চল, আজকে একটা সুন্দর ব্যবস্থা হবে। কাছেই একটা বিয়ে আছে। সেখানে গিয়ে খেয়ে আসব।
: কিন্তু গিফ্ট?
: গিফ্ট লাগবে না। আমরা সাজব বরপক্ষ।
সন্ধ্যার পর দুজনেই ভালো পোশাক পরল। হোস্টেল থেকে খুব দূরে নয় বাড়িটা। গেটে অভ্যর্থনা করতে দাঁড়িয়ে থাকা মুরব্বিদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে বলল, আমরা বরের আত্মীয়। একটু তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি।
: তাতে কী? আসুন! আসুন!
মহাসমাদরে তাদের ভিতরে নিয়ে যাওয়া শুরু হলো। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা ফুল বর্ষণ করল। খুশিতে ডগমগ হয়ে ভেতরে অগ্রসর হতেই বাঘ দেখার মতো চমকে উঠল তারা। আলিমের দুলাভাই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
: তোমরা আবার বরের আত্মীয় হলে কবে থেকে? আমারই বন্ধুর ছেলের সঙ্গে আমার আরেক বন্ধুর মেয়ের বিয়ে তাই আমি এসেছি।
ধরা পড়ে মুখটা আমসি হয়ে গেল আলিমের। তাড়াতাড়ি হাতে ধরে টেনে দুলাভাইকে আড়ালে নিয়ে নিচু স্বরে বলল, আব্বু, ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারে না। ক’দিন ধরে হোস্টেলে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া হয় না তাই এসেছি। আমরা কারও কিছু হই না।
: ঠিক আছে। চিন্তা করিস না।
কনের বাবাকে তিনি বললেন, ওরা বরের লোক। তাই খাবারটা একটু তাড়াতাড়ি সার্ভ করতে।
: বরের লোক হলে বরের সঙ্গে স্পেশালভাবে খাবে। আর বর না এলে তো খাবার সার্ভ করা হবে না।
আলিম এবার কপট ডাঁট দেখাল- আমাদের আবার একঘণ্টা পরেই ট্রেন। মফস্বল থেকে এসেছি। তাহলে চলে যাই আংকেল!
: সে কী! আমার মেয়ের বিয়েতে না খেয়ে চলে যাবেন তা হয় না।
তক্ষুনি কেবল ওদের দুজনের জন্য কোনার একটা আলাদা টেবিলে খাবার বন্দোবস্ত করলেন। তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে ধরা পড়ার ভয়ে বর আসার আগেই পালিয়ে গেল ওরা। কিন্তু দুলাভাই এত সহজে ছাড় দিলেন না। এক সপ্তাহ পরেই হোস্টেলে হাজির হলেন তিনি।
: আলিম, তোর সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি। আমার পরিচিত এক বিজনেসম্যান ডাক্তার ছেলে খুঁজছিল তার মেয়ের জন্য। তা তুই তো এমবিবিএস থার্ড ইয়ারে মানে তিন পঞ্চমাংশ ডাক্তার। তোর ছবি দেখিয়ে সব কথা বলেছি। তারা রাজি। তোর গার্জেনদের মতোও নিয়েছি। থাকা-খাওয়ার অভাব হবে না। পাস করলে ক্লিনিকও বানিয়ে দেবে। নিজে কিছু চাইতে হবে না।
: কিন্তু মেয়ে দেখব না ?
: তুই তাকে দেখলে, মেয়েও তোকে দেখবে। তোর রংটা একটু ময়লা, মাথায় চুলও একটু কম। ওই বড় লোকের মেয়ে যদি ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলে। তারচেয়ে ছবিটা দেখ, আর এই নে ফোন নম্বর।
ছবিটা দেখেই আলিমের মাথা ঘুরে গেল। কোনো দিন মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করেনি। ফোনে কী কথা বলবে ভেবে পেল না। তবু বিয়ের আগের ক’দিন মেয়েটাকে পটালে মন্দ হয় না। ভাবল সে।
: আপনি যে এত সুন্দর তা ভাবতেও পারি না।
: সৌন্দর্যের আসল মাপকাঠি তো মন।
: ঠিকই বলেছেন। আপনার মুখে যদি গুটিবসন্তের দাগ থাকতো তাও ভালোবাসতাম, যদি কোনো দাঁত না থাকত তাও ভালোবাসতাম।
: কী বলছেন এসব? আমি কি বুড়ি?
আর কথা এগুলো না। মেয়েটা ফোন রেখে দিলো। বিয়ের দু’একদিন পূর্বে পঞ্চম বর্ষের রাশেদ যিনি প্রথম বর্ষে থাকতেই বিয়ে করেছেন; উপদেশ দিলেনÑ ছোট ভাই, শুনেছি তুমি খুব বড় লোকের মেয়ে বিয়ে করছ। সাবধান! প্রথম রাতেই কিন্তু বিড়াল মারতে হবে, নয়ত বিপদে পড়বে।
এর আগেও বহুদিন এসব কথা শুনেছে আলিম কিন্তু মর্মার্থ বোঝেনি। তখনই সে ডাইনিং হলের বয় কালুকে দাওয়াত করল : তুই আমার বিয়েতে যাবি। তোকে দাওয়াত দিলাম।
কালু ভীষণ খুশি। এ হোস্টেলের কত স্যার ডাক্তার হয়ে বিয়ে করেছে কেউ তাকে দাওয়াত দেয়নি।
: কিন্তু আমি গরিব। আপনার বিয়াতে কেমনে উপহার দিমু?
: তোকে কোনো উপহার দিতে হইব না। ডাইনিং হলের বিড়ালটা তো তোর ন্যাওটা। ওইটারে ধইরা সুন্দর একটা ব্যাগে ঢুকাইয়া মুখ আটকাইয়া লইয়া যাবি। খাওয়াদাওয়ার পর যখন চামু তখন দিবি। কাউ রে বলবি না, দেখাবিও না।
নির্দিষ্ট দিনে ধুমধাম করেই বিয়ে হলো। শীতের রাত। দশটার পরই একে একে অভ্যাগতরা চলে গেল। এগারটার দিকে বাসর ঘরে ঢোকার মুহূর্তে কালুর কথা মনে পড়ল তার। আলিমকে বাইরে যেতে দেখেই শ্বশুরবাড়ির এক মুরব্বি বললেন, কোথায় যাচ্ছ, বাবাজ?
: এই আসছি।
বলে ছুটে বেরিয়ে গেল সে।
কালু তখনো গেটের কাছে ব্যাগ হাতে দণ্ডায়মান। সেটা নিয়ে বাসর ঘরে ঢুকে দরজা লাগাল আলিম। দেখে অসংখ্য ফুলে সজ্জিত বিছানায় পা তুলে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে বউ। মাথা নিচু করে। এক মুহূর্ত চিন্তা করল কোনটা আগে করবে। ঘোমটা তুলবে নাকি প্রয়োজনীয় কাজটা সারবে? দরকারিটাই আগে করা উচিত। সন্তর্পণে ব্যাগটা সে বিছানায় রাখল। তারপর চেইন খুলে শেরোয়ানির ভেতরে লুকিয়ে আনা ছোট একটা লাঠি দিয়ে বাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করল। বেড়ালটি এতক্ষণ পর ছাড়া পেয়ে দরজা জানালা বন্ধ থাকায় কোনোদিকে যেতে না পেরে মিয়াও বলে বিদঘুটে একটা চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে বউয়ের কোলে পড়ল। বউ ঘোমটা-আঁচল ফেলে ‘মা গো’ বলে আর্তচিৎকার দিল। তারচেয়েও জোরে তিন ফুট লাফিয়ে খাট থেকে নেমে দরজার দিকে ছুটল। যেতে যেতে বলল, পাগল! আমাকে একটা পাগলের সঙ্গে বাবা বিয়ে দিয়েছে।
দরজা খুললে আরও লজ্জায় পড়বে ভেবে আলিম দরজা আটকে রাখার চেষ্টা করল। বলল, আমি পাগল নই।
বিয়ের প্রথম রাতে বিড়াল মারতে চেয়েছিল তা বলল না। বউ মাইন্ড করবে ভেবে। একটা মনগড়া কাহিনী দাঁড় করাল- ওই বিড়ালটা আমার খুব প্রিয়। সব সময়ের সঙ্গী। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না। তাই বাসর রাতেও নিয়ে এসেছিলাম।
ততক্ষণে বউ দরজা খুলে ফেলেছে। মুরব্বিরা উৎকণ্ঠিতভাবে তাকিয়ে আছে। অল্প বয়স্ক ভাবি ও বান্ধবীরা মুখ টিপে হাসছে। বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বউ ডুঁকরে উঠল- ড্যাডি, একটা ক্যাটকে সতীন বানিয়ে ওই লোকটার সঙ্গে সংসার করতে পারব না।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228