মোরগ আগে
আবুল কালাম আজাদ
🕐 ৩:২৯ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০৩, ২০২০
বিমল স্যার মাঝে মাঝে ক্লাসে রস-রসিকতার গল্প করেন। সেদিন ক্লাসে এসে বললেন : পটকা, বল তো মুরগি আগে, না ডিম আগে?
পটকা ঠাস করে দাঁড়িয়ে গেল। অভার কনফিডেন্স নিয়ে বলল : স্যার, মুরগি আগে।
: যুক্তি দেখা।
: স্যার, মুরগি ছাড়া ডিমের কথা কল্পনা করাও সম্ভব না। তারপরও কিছু লোক এ ব্যাপারে ফাও তর্ক করে।
বিমল স্যার বললেন : গোল্লা, তুই কি পটকার সঙ্গে একমত?
গোল্লা বলল : জি না স্যার। একমত হওয়া সম্ভব না। ডিমের ভিতর থেকে বের হয় মুরগির বাচ্চা। সেই বাচ্চা ধীরে ধীরে বড় হয়ে হয় মুরগি। আগে বাচ্চা, পরে মুরগি। তাই ডিমই আগে।
সবচেয়ে পেছনের বেঞ্চে হাত তুলে বসে আছে ক্যাবলা। সবাই খুব অবাক হলো। বরাবর প্রতি ক্লাসে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। নাক ডেকে ঘুমায়। আর আজ সে হাত তুলে বসে আছে।
বিমল স্যার বললেন : কী রে ক্যাবলা, তুই কি কিছু বলবি?
ক্যাবলা গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়াল। বলল : স্যার, মুরগিও আগে না, ডিমও আগে না। তর্কটাই অবান্তর।
: মানে?
: মানে মোরগ আগে।
: মোরগ আগে! এরকম কথা তো কেউ কখনো শোনেনি। বুঝিয়ে বল তো।
: স্যার, ধরেন মুরগি আছে। মুরগির ডিমও দিয়েছে। কিন্তু কোনো মোরগ নাই। সেই ডিম থেকে কি বাচ্চা হবে? বলেন স্যার, বাচ্চা হবে?
: না, তা হবে না।
: আবার ধরেন, যে কোনোভাবেই হোক মুরগি নাই কিন্তু ডিম আছে, তবে মোরগ নাই। সেই ডিম থেকেও বাচ্চা হবে না। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার প্রধান ও একমাত্র শর্ত মোরগ। স্যার, ঠিক বলেছি কিনা বলুন?
: তোর কথা ঠিক আছে। তবে অনন্তকাল ধরে তর্কটা মুরগি আর ডিম নিয়ে।
: মানুষ গভীরে গিয়ে ভাবতে চায়নি বলেই বিষয়টা নিয়ে অকারণ তর্ক করে যাচ্ছে।
: তুই নিশ্চয়ই গভীরে গিয়ে চিন্তা করেছিস। ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করে বল। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।
: এ্যাডাম-এর কথা ভাবুন। সবরকম প্রাপ্তির মধ্যে থেকেও এ্যাডামের ‘কিচ্ছু ভাল্লাগেনা অবস্থা’। যেই ইভকে পেল অমনি সে স্বর্গ থেকে বের হয়েও শান্তি সাগরে অবগাহন করতে লাগল। তেমনি প্রথমে তৈরি করা হয়েছিল মোরগ। নানারকম সুস্বাদু পোকা, শস্যদানা ছড়ানো ছিল তার পাশে। কিন্তু তার মনে শান্তি ছিল না। সে কোনো সুস্বাদু পোকা মুখে তুলে নেয় না, কোনো শস্যদানায় ঠোকর দেয় না। মন খারাপ নিয়ে আমড়া গাছের ডালে বসে থাকে আর গান গায়Ñ একা একা কেন ভালো লাগে না/ কোনো কাজে মন কেন বসে না/ আমার কী হতে কী হয়ে গেল/ আমি নিজেই তো কিছুই বুঝি না ওওও... ।
: তুই বলতে চাচ্ছিস যে, মোরগ তখন বাংলা সিনেমার গান গাচ্ছিল?
: বাংলা সিনেমার গান কোথায় পেলেন? বাংলা সিনেমা মানেই তো নকল। হলিউড, বলিউড যে কোনো জায়গা থেকে মারিং...। মোরগের গান মেরে দেওয়া ওদের জন্য কোনো ব্যাপার?
: তারপর বল।
: তারপর আর কী! গান শেষ হতেই মোরগ দেখে, তার পাশে বসে আছে এক রূপসী মুরগি। মোরগ বলে উঠল, আমাকে দু’দ- শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন। ক’দিন পর বনলতা সেন ডিম দিল। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলো।
ক্লাসের সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিল ক্যাবলার যুক্তি। এবার তারা একযোগে প্রশ্বাস ত্যাগ করল। বিমল স্যার বললেন : তুই এত গভীরে গিয়ে সবকিছু ভাবতে পারিস, অথচ এত বছর ধরে এক ক্লাসে বসে আছিস।
: স্যার, ক্লাস টপকানোর সঙ্গে জ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নাই। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, আরজ আলী মাতুব্বর এরা কয়টা ক্লাস টপকিয়ে ছিলেন বলেন তো? সত্যিকারে জ্ঞানী মানুষ ক্লাস টপকানোর ধার ধারে না। আমার এই মোরগ তত্ত্ব সুদীর্ঘকালের তর্কের অবসান ঘটাবে। মোরগ তত্ত্বের জনক হিসেবে আমার নাম অমর হয়ে থাকবে। যারা আমাকে ফেলে অনেক দূরে চলে গেছে, পেছন থেকে এসে যারা আমাকে ফেলে চলে যাবে তারা কেউ ইতিহাস হবে না। এই একটা মাত্র তত্ত্বের জন্য ইতিহাস হব আমি।
: কিন্তু তুই তো আদুভাই হয়ে যাচ্ছিস।
: আদুভাই কে স্যার? খুব বড় কোনো দার্শনিক? কোন কোন তত্ত্বের জনক তিনি?
: ছেলের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তে যাওয়ার অপমান থেকে বাঁচতে গিয়ে আদুভাই এমন পড়া পড়ে যে, সেই পড়ার কারণেই পটল তোলে।
: এটা কোনো কথা হলো? ছেলে, নাতি-পুতি যে কারও সঙ্গে এক ক্লাসে পড়া যায়। এর জন্য পটল, বেগুন, মরিচ কোনো কিছুই তোলার দরকার হয় না। স্যার, ধরেন আমি আর আমার নাতি একই ক্লাসে পড়ি। নাতি কিন্তু এতে গর্ববোধ করবে প্রচুর। বন্ধুদের ডেকে বলবে, আমরা যে মোরগ তত্ত্বটা পড়ি সেটা কিন্তু আমার দাদা ক্যাবলা চাঁনের। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি তত্ত্বের জনকের নাতি আমি।
মফিজ উঠে গিয়ে হোয়াইট বোর্ডে লাল রঙে লিখল : মুরগিও না, ডিমও না- মোরগ আগে। বিখ্যাত এ মোরগ তত্ত্বের জনক আমাদেরই ক্লাসমেট বাট বড়ভাই ক্যাবলা চাঁন।
ঠিক তখনই ক্লাসে ঢুকলেন হেডস্যার আজগর আলী। তিনি সাড়ে তিন মিনিট বোর্ডে তাকিয়ে থাকলেন অপলকে। তারপর বললেন : মোরগ আগে মানে? হোয়াট ইজ থিওরি অব কুক?
পুরো ক্লাস চুপ।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228