ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নস্টালজিকে ঢুকে যাওয়া দুর্নীতি

অমল সাহা
🕐 ৪:৪৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ০৫, ২০১৯

আহা! দুর্নীতির কথা মনে হলেই কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে পড়ি। অন্য কথায় বলতে গেলে, নষ্ট+লজিক হয়ে পড়ি। আজ থেকে কী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত? ছোটবেলা থেকে এর হাতেখড়ি। কোথা থেকে শিখেছি? বড়দের কাছ থেকে। পাঠ্যপুস্তকের কাছ থেকে। আমরা ছোটরা ভোরবেলায় পূজার ফুল আনতে যেতাম প্রতিবেশীদের বাড়ি কিংবা কোনো সরকারি অফিসের বাগানে। তখন সুযোগ মতো দু’একবার ফুল চুরিচামারিও করতাম। ফুল আনার দায়িত্ব আমাদের সেই আধা শহুরে বাড়ির ছোটদের কাঁধেই ছিল।

সেই ফুল দিয়ে বাড়ির ঠাকুমা দিদিমারা আরামসে পূজা-পার্বণ সারতেন। বিশেষ বিশেষ পূজার সময়ে ফুলের বেশি দরকার হতো। তখন আমরা পড়তাম বিপদে। একবার লক্ষ্মীপূজার সময় আমরা তিন-চার বন্ধু মিলে শহরের এক প্রান্তে অবস্থিত এক জুটমিলের অফিসে অন্ধকার থাকতে থাকতে গিয়ে হাজির হলাম। আমাদের জানা ছিল অফিসের সামনে বিরাট বাগান। উদ্দেশ্য মহৎ। চুরি করে হলেও ফুল সংগ্রহ করা। কিন্তু অফিসের সামনে গিয়ে পুরা হতাশ! ভোরের আধো অন্ধকারে হাতে একটা দেড়হাতি লাঠি নিয়ে এক দারোয়ান বেটা বাগানের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সন্দেহজনক গতিবিধির ওপর নজর রাখা শুরু করেছে। আমাদের চোরের মন। স্বভাবতই ভীতু। আমরা উপায় বের করার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করতে করতে অন্ধকার সরে গিয়ে সূর্য বেইমানি করে আকাশে উঠে গেল।

আমরা মরিয়া হয়ে শলাপরামর্শ করে দারোয়ানকে এক টাকা (তখন এক টাকা দিয়ে দুই হালি ডিম কেনা যেত)। ঘুষ দিয়ে সিসেম ফাঁক করার পরিকল্পনা করলাম।

কিন্তু ঘুষ দেওয়া গর্হিত অপরাধ (তখন পর্যন্ত জানতাম)। যদি দারোয়ান সাহেব না নিয়ে ঘুষ সাধার অপরাধে আমাদের উল্টো কোমরে দড়ি দেয়? এসব ভাবতে ভাবতে চারদিকে তখন কিছু লোকজন চলাচলও শুরু করে দিয়েছে। নাহ, রিস্ক একটা নিতেই হবে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী কে? কেউ স্বীকার করল না কে সাহসী। অগত্যা সিদ্ধান্ত নিলাম, সবাই একসঙ্গেই দারোয়ান সাহেবকে ঘুষ সাধবো। যা থাকে কপালে। দুরুদুরু বক্ষে এগিয়ে গেলাম। দারোয়ান সাহেব আমাদের দেখে এগিয়ে এলো। আমাদের মধ্যে একজন অতি ভয়ে প্রস্তাব পাড়লো, আমাদের ফুল নিতে দিলে আপনাকে এক টাকা দেব। ঘুষ শব্দটা উহ্য রাখলো। দারোয়ান সাহেব এদিক-ওদিক ইতিউতি তাকিয়ে বিরক্তির স্বরে বলল, আন্ধার থাকতে কইলা না ক্যান? এহন ট্যাকা নেওন যাইবো না। লোকজন দেখলে আমার চাকরি থাকবো? যাও যাও মিয়ারা ঘুষ দেওয়ার সাহস নাই, কাম হাসিল করতে আইছো!

আমরা হতভম্ব! কী ভুলটাই না করেছি! ফুল পাই নাই। তবে একটা শিক্ষা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম, ঘুষ দিয়ে ‘কাম’ হাসিল করা যায়। এখন বসে ভাবি, চল্লিশ বছর আগে সূর্যের আলোকেও মানুষ লজ্জা পেত।

কাগজের দিস্তা ছিল এক টাকা। আমি পড়ি সিক্সে। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনে আনলাম ‘এক দিস্তা’ কাগজ। কিন্তু বাবা যে বাসার গেটের সামনেই দুদক চেয়ারম্যান হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বুঝতে পারিনি। গেট দিয়ে ঢুকতেই বলল, ‘এদিকে আয়।’ আমি শেষ। বাবা কাগজগুলো নিয়ে গোনা শুরু করার পর আমি এক দৌড়ে পগারপার হওয়ার চেষ্টা করতেই বাবা হাত ধরে ফেললেন। কাগজ তো এখানে এক দিস্তা পুরা নাই। চার আনা মেরে বারো পাতা কিনেছি! চার আনা দিয়ে ডালপুরী সাঁটিয়েছি। বাবা কাগজ গোনা শেষ করে বললেন, আর কাগজ কই? আমার মুখে কোনো কথা নাই। প্রমাণসহ ধরা। কী বলার আছে? মা সামনে দাঁড়িয়েছিল। মা বলল, একটা থাপ্পড় মারো! (এখনকার মতো তখন এত আহ্লাদ ছিল না)। বাবা বললেন, কান ধর। ধরলাম। এ আর এমন কী! উঠবস করলাম দশবার। সেদিন খুবই লজ্জা পেয়েছিলাম। এখন বড় হয়ে চারদিকে দেখি জাতীয়ভাবে সবাই বলছে, এ আর এমন কী!

আরেকটা ঘটনা বলে শেষ করি। কয়েকদিন আগে আমার এক মাঝারি আকারের ব্যবসায়ী বন্ধুর গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম। বন্ধু নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছে। জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেটা তো উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। ছেলেটাকে কী পড়ানো যায় বলো তো? আমার বন্ধু এক মুহূর্তও দেরি না করে নির্দ্বিধায় বলল, মিটার রিডার নয়তো পিয়ন বানাও। এক হাজার কোটি টাকার মালিক হতে পারবে। তদবিরবাজও বানাতে পারো। বন্ধুর মুখ তিক্ততায় কালো হয়ে গেছে। আমি আফসোস করে বলি, সে কপাল কী আর আছে! ছেলেটা তো ভালো ছাত্র।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper