ট্রাফিকের ৪০ টাকা
শফিক হাসান
🕐 ২:২২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৯
ট্রাফিকের নামের সঙ্গে পুলিশ শব্দটা শোভাবর্ধন করলেও দুয়ের তুলনায় ট্রাফিককে সৎ ভাই-ই বলতে হয়! পুলিশের কত ক্ষমতা মালকড়ি কামানোর, অন্যকে ঠেঙানোর ও ঠেকানোর! অন্যদিকে ট্রাফিকের ক্ষমতা একমুখী গাড়ির ওপর। চাইলে তারা মন্ত্রী কিংবা যে কোনো ক্ষমতাবানের গাড়ি থামিয়ে দিতে পারে; কিন্তু পাত্তি না এলে এমন ক্ষমতায় কাজ কী! বড়জোর তাদের ছেলেমেয়েরা পরিচিতদের কাছে বীরপুঙ্গব বাবার গল্প শোনাতে পারে!
পুলিশ বাহিনীর অসৎ সদস্যরা যদি হয় বিষাক্ত গোখরো, সেখানে ট্রাফিক পুলিশ নির্বিষ ঢোঁড়া বৈ কিছু নয়! এ ট্রাফিক পুলিশই উল্টো আমাকে উৎকোচ দেবে ভাবিনি কোনোদিন!
সেদিন তাড়া ছিল, দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। এদিকে যে রিকশাঅলাকেই ডাকি, তাদের এক কথা যামু না। চেহারা-সুরত ভালো না দেখেই হয়তো পছন্দ হয় না। এক রিকশাঅলাকে দেখলাম আমাকে প্রত্যাখ্যানের পর ইউনিফর্ম পরিহিত এক স্কুলছাত্রীকে ডাকতে অ্যাই, কই যাইবা?
সেই ছাত্রী তার দিকে ভ্রূক্ষেপও করল না। এবার সে দূর থেকে হেঁটে আসা এক তরুণীকে আহ্বান করল আপা, কই যাইবেন? তরুণী শুনলো-দেখলো কিন্তু কর্ণপাত-দৃষ্টিপাত কোনোটাই করল না। বহাল রাখলো হাঁটার ছন্দ। একদিকে রিকশা পাচ্ছি না, কপালে অপেক্ষা করছে দুর্ভোগ; অন্যদিকে এ ফাজলামি? ইচ্ছা করল, ব্যাটাকে ধরে দুইটা চটকানা মারি। কিন্তু পারলাম না, লাখ হলেও আমি একজন ভদ্রলোক! কে দেখে ফেলে আবার কোন জায়গায় লাগিয়ে দেয়!
শেষমেশ এক তাগড়া রিকশাঅলাকে পেলাম। জানালাম, আমার একটু তাড়া আছে, সে যেন একটু জোরে চালায়। উত্তরে শোনালো, ট্রাফিক পক্ষ চলছে। এ সময় তাড়াহুড়ায় কাজ হবে না। তাড়ার কথা শুনে রিকশার গতি আরও কমিয়ে দিল। তিন ঘণ্টায় এক মাইল যাবে, এমন গতি। এর চেয়ে হেঁটেও আগে যাওয়া যায়। ওকে আবার তাড়া দিলে বলল, বেশি জরুরি হলে অন্য রিকশায় যান। অনেক কষ্টে রাগ থামালাম। ব্যাটা আস্ত একটা বদমাশ। এ সময় পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেল পরপর তিনটি রিকশা। দেখিয়ে বললাম, ওদের জন্য ট্রাফিক পক্ষ চলছে না!
পেছনের রিকশায় কে বইছে দেখছেন?
না, দেখিনি। যাত্রী ছাড়া আর কে বসবে?
এক সুন্দরী আপা বইছে।
তাতে তোমার কী?
তারে আমার রিকশায় তুইলা দেন, ট্রাফিক পক্ষ-মক্ষ কিছুই মনে থাকবো না!
শালা তো আচ্ছা গাড়ল! পক্ষান্তরে আমাকে গান শুনিয়ে দিল ‘পুরুষ না হয়ে কেন মাইয়া হইলা না’! বললাম, মানুষের সুবিধা-অসুবিধাও বুঝতে হয়।
ভালো কথা বলেছেন। জ্যাম লেগেছে, দ্যাখেন। এটা এক ঘণ্টায় ছুটবে না। কাছেই আমার বাসা। আমি ঘুমাতে গেলাম। জ্যাম ছাড়লে ডাক দিয়েন!
এ ফাজলামির মধ্যে আর থাকা যায় না। হেঁটেই যাব। নেমে ভাড়া দিতে ১০০ টাকার নোট বের করলাম। সে স্পর্শ না করে কবিসুলভ ভাব নিয়ে বলল, ভাংতি নাই!
ভাংতি করো!
দেখেন এখানে লেখা আছে ১০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকার ভাংতি নাই। ভাংতি না নিয়ে রিকশায় উঠবেন না।
তাকিয়ে দেখলাম, রিকশার পেছনের অংশে যেখানে নায়ক-নায়িকা ও সিনেমার পোস্টারসদৃশ চিত্রকর্ম শোভা পায় সেখানেই কথাগুলো লেখা। সতর্কবার্তার নিচে লেখা আর্ট : মোখলেস ভাই। ভালো মাইনকা চিপায় পড়লাম। এর যে নবাবি অবস্থা, তাতে মনে হয় না সে সতীর্থ রিকশাঅলাদের কাছে ভাংতি চাইবে। নিজেই এগিয়ে গিয়ে ভাংতি চাইলাম কয়েকজন রিকশাঅলার কাছে। একজন বলে বসলো, এত বড় বড় নোট আপনারা যে কই পান বুঝি না!
আরেকজন বলল, ভাংতি নাই, সামনে দেখুন।
আমার বেতাল অবস্থা দেখে গাড়লটা মুখ কেলিয়ে হাসছে। রাগ সামলে গেলাম রাস্তার ওপাশে খিলিপান দোকানে। সিগারেট খাই না, তবু একটা স্টার ও দুইটা চকোলেট নিলাম। একশ টাকার নোটটা বাড়িয়ে দিলে দোকানি অপাঙ্গে দৃষ্টি হেনে বলল, মশকরা করবার লাগছেন নি?
টাকাটা রাখুন।
ভাংতি টাকা দেন। এইটা বাট্টার দোকান না, পান দোকান।
সবেমাত্র মুখে পোরার জন্য একটা চকোলেট আবরণমুক্ত করেছি, দোকানি বোঝার আগে আলগোছে সেটা রেখে দিলাম বয়ামে। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে দেখি, রিকশায় বসেছে নতুন যাত্রী। কলেজপড়–য়া প্রেমিক-প্রেমিকা বোধহয়। রিকশাঅলা আমাকে দেখিয়ে বলল, এই তো চলে এসেছেন। উনার ভাড়া নিয়ে বিমানের গতিতে উড়ে যাব!
ভাংতি পাইনি বলায় রিকশায় বসা প্রেমিক খেঁকিয়ে উঠল, কেমন যাত্রী আপনি, ভাংতি নিয়ে রিকশায় উঠতে পারেন না?
তার রাগের কারণ বুঝতে বুদ্ধিজীবী হতে হয় না। ঝামেলা না থাকলে এতক্ষণে তার হাত থাকতো সহযাত্রীর কোমরে। আমারই জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।
মেয়েটা বিরক্তি ও তাচ্ছিল্যের যুগপৎ মিশ্রণে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। উপরে দুলছে নারকেলের চিরল পাতা। আমার দিকে নেত্রপাত করার রুচি নেই তার। একবার মন চাইলো, একশ টাকাই রিকশাঅলাকে দিয়ে দিই। পরক্ষণে ভাবলাম, বেয়াদবটাকে একটা টাকাও বেশি দেব না।
একটু পরেই মেইন রোড। দেখা যাচ্ছে, কর্তব্যরত এক ট্রাফিক পুলিশকে। কাছে গিয়ে ভাংতি চাইলে তেরছা চোখে আমাকে মাপলেন তিনি। বললেন, ১৯ বছরের ট্রাফিক-জীবনে কেউই আমার কাছে ভাংতি চায়নি। ভাংতি দিয়ে গেছে!
একটু উপকার করুন, ভাই। বিপদে পড়েছি। রিকশাঅলা অপেক্ষায়, ভাড়া দিতে পারছি না।
ভাংতি চাহিয়া লজ্জা দেবেন না।
দুই-চার মিনিট অপেক্ষা করি? গাড়ি এলেই তো ভাংতি হয়ে যাবে!
চোখ-মুখ বিকৃত করে একটা অশিষ্ট শব্দ উচ্চারণ করলেন তিনি। এ সময় দূর থেকে আসতে দেখা গেল লক্কড়ঝক্কড় এক বাসকে। ইশারায় বাস থামলো। ড্রাইভারের কাছে গিয়ে বললেন, অসুবিধায় আছি, কাগজপত্র দেখতে পারব না। বুইঝা ল!
বাস কন্ডাক্টর ‘বুঝে নিয়ে’ আলগোছে পাওনা মিটিয়ে দিল। ট্রাফিক ফিরলে বললাম, ভাংতি হলো?
আপনার রিকশা ভাড়া কত? ২০ টাকা।
২০ টাকা নিয়ে যান। এ তল্লাটে আপনাকে যেন আর না দেখি। ট্রাফিকের কর্তব্যকর্মে বাধা দিয়ে বারবার আইনভঙ্গ করছেন!
দিচ্ছেন যখন আরও ২০ টাকা দিন।
ততক্ষণে আরেকটা ‘সমস্যাযুক্ত’ বাস এলে ট্রাফিক ইশারায় থামালেন। চালকের আতঙ্কিত চেহারা বলে দিচ্ছে, বড় দাঁও মারা হবে এবার!
৪০ টাকা নিয়ে যখন এলাম, রিকশা নেই! জুটির তাড়া আমার চেয়েও বেশি। প্রেমিক বেচারার হাত এবার শান্ত হোক, প্রেমিকার মন শান্তি পাক! ট্রাফিক পুলিশের কাছ থেকে চাঁদাবাজির ৪০ টাকা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বিমলানন্দ অনুভব করলাম।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228