ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আমের নতুন চমক ‘ইলামতি’

বৈশিষ্ট্যে অভিভূত বিজ্ঞানীরা, সম্প্রসারণে আগ্রহী বিজ্ঞানীরা, পাকছে অন্যান্য জাতের অনেক পরে

আব্দুর রব নাহিদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
🕐 ১২:০৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৮, ২০২১

আমের নতুন চমক ‘ইলামতি’

আম মৌসুমের শুরুতে যে পরিমাণ আম পাওয়া যায় ও জাত বৈচিত্র্য থাকে, শেষে এসে তা হয়ে যায় অনেকটা হাতেগোনা, আমের প্রচলিত জাতগুলোর মধ্যে আর্শ্বিনা সবচেয়ে শেষে পাকে, আর্শ্বিনার মধ্য দিয়েই শেষ হয় আমের মৌসুম। আম মৌসুমের শেষ সময়ে আশি^নার পাশাপাশি যদি আরও কয়েকটা জাত থাকত, আরও কিছুদিন যদি গাছে গাছে আম থাকত, সবাই আমের স্বাদ নিতে পারত। প্রকৃতিই যেন আমপ্রেমীদের সেই ইচ্ছা পূরণ করে দিয়েছেন। প্রাকৃতিকভাবেই হওয়া একটি নাবি জাত নিজস্বতা নিয়ে সামনে এসেছে। আমটির বৈশিষ্ট্য দেখে অভিভূত চাঁপাইনবাবগঞ্জের হর্টিকালচার সেন্টারের বিজ্ঞানীরা।

আর্শ্বিনার পরও এই নাবি জাতটির আম পাকছে। গেল দুই বছর নাবি এ জাতটি পর্যবেক্ষণ করে সম্প্রসারণে আগ্রহী হয়েছে বিজ্ঞানীরা। শুরু করেছেন নাবি জাত হিসাবে মুক্তায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া। ‘ইলামতি’ নামে মুক্তায়নের প্রস্তাবনা তাদের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালা ইউনিয়নের বেলাল বাজার, এখানেই পারিবারিক বাগান রয়েছে আতিকুল ইসলাম আরমানের বাবা ও চাচাদের। প্রতি বছরই বাগানটি মুকুলেই আম ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতেন তারা। তাদের বাগানে বিভিন্ন জাতের আমগাছের পাশাপাশি ৫টি গাছ ছিল গুটি জাতের। আমগাছগুলো তারা একই ইউনিয়নের কদমতলী এলাকায় তাদের দাদার ভিটামাটিতে থাকা পুরনো আমের গাছ (মাতৃগাছ) থেকে কলমের মাধ্যমে এনে লাগিয়েছিলেন, ইচ্ছা ছিল গাছগুলো একটু বড় হলে, সেগুলোকে প্রচলিত আর্শ্বিনা বা অন্য কোনো জাতের কলম করে নেবেন। কিন্তু গাছগুলোতে আম ধরতে শুরু হলে, আমের আকার ভালো হওয়ায় আর অন্যকোনো জাতে পরিবর্তন করা হয়নি। এভাবেই থেকে যায় ৫টি গাছ। সাধারণত ল্যাংড়া, বা ফজলি আমপাড়ার সময়ই ওই ৫টি গাছের আম ভেঙে নেওয়া হত, তবে আমগুলো কাঁচাই থাকত, কিন্তু যারা বাগান কিনতেন তারা শুধু ৫টি গাছের জন্য আলাদাভাবে শ্রম দিবেন না তাই আম পেড়ে নিতেন।

তবে ২০১৬ সালের দিকে আতিকুল ইসলাম আরমান নিজেই নাম লেখান আম ব্যবসায়, সে বছর তিনি পাশের আর্শ্বিনা আমের বাগানের আম কিনেছিলেন। তাই প্রায় আম মৌসুমের শেষ পর্যন্ত চলে তার আম কেনাবেচা। বাগানের অন্যসব জাতের আমপাড়া শেষ, বাগানের ওই ৫ গাছের আম তখনও পাকেনি, আতিকুল ইসলাম ভাবেন যতদিন গাছে আম না পাকে, ততদিন আম পাড়বেন না। সেই ভাবনাতেই যেন উন্মোচিত হলো নাবি এক আমের জাতের।

আতিকুল ইসলাম বলেন, যেহেতু আর্শ্বিনা বাগানে আম আমার কেনা ছিল, তাই ওই ৫টা গাছে আম পাকা দেখা দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। যখন আমার মনে হয়েছে আমটা টেকশই, লেটে পাকে। সেবার ৬ হাজার টাকা মন করে আম বিক্রি করলাম। তার পরের বার খুব বেশি আর হয়নি, তার পরের বার শিলাবৃষ্টির কারণে আমে দাগ হয়ে গেছিল, তারপরও সাত হাজার ৩০০ টাকা মনে বিক্রি হয়েছিল। গতবার ৪ সেপ্টম্বর পর্যন্ত গাছে আম রেখেছিলাম, আরও কিছুদিন রাখা যেত তারপরও গতবার ১০ হাজার ২০০ টাকা মন ধরে বিক্রি করেছিলাম ১০ মন আম।

আতিকুল ইসলামের পারিবারিক এ বাগানের ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আমের কথা ২০১৮ সালের দিকে জানতে পারেন চৌডালা ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মু মোমিনুল ইসলাম। এরপর তিনি নিজে বিষয়টি সেই মৌসুমে পর্যবেক্ষণ করেন। পরের মৌসুমে ২০১৯ সালে তিনি বিষয়টি তার অফিসের তৎকালীন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহকে জানান। কিছু দিনের মাথায় হাবিবুল্লাহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টার উদ্যাতত্ত্ববিদ হিসাবে বদলি হন। বদলি হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টার উদ্যানতত্ত্ববিদ হাবিবুল্লাহ গাছগুলো পর্যবেক্ষণেই রেখেছিলেন।

চৌডালা ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মু মোমিনুল ইসলাম জানান, আমের ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেখে বেশ কয়েক বছর আগে ৩০টি ডগা নিয়ে, নাচোলে বাগান গড়ে তুলেছেন একজন। তার বাগানেও প্রায় ১৮০টি গাছ আছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত্ববিদ মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ জানান, হর্টিকালচার সেন্টারে মাধ্যমে তাঁরা নাবি ও আগাম জাতের আমের জাত খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন। গোমস্তাপুর ও নাচোল উপজেলায় দুটি বাগানের বিষষ জানতে পারেন। এরপর গোমস্তাপুরের বাগানের গাছগুলো গত দুই বছর পযবেক্ষণ করেছেন তিনি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত্ববিদ মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ মতে সন্ধান পাওয়া আমটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে। এটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি নাবি জাতের, সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ পযন্ত এ আমগাছে রাখা যায়। এর গড় ওজন ৪২৭ গ্রাম, মিষ্টতা বা টিএসএস শতকরা ২১-২২ ভাগ, পাকালে হালকা হলুদাভাব সবুজ রং ধারন করে ও সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, আমরা এর আগে নাবি জাত হিসাবে গৌড়মতি মুক্তায়িত করেছিলাম। আমাদের সন্ধান পাওয়া এই গুটি আমটি গত বছর ও এ বছর পর্যবেক্ষণ করেছি, এর মিষ্টতা গৌড় মতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। আমটিকে আদালা বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের আকৃষ্ট করেছে। নাবি জাত হিসাবে আমটি সম্ভাবনাময়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, আমরা জানি এ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য ইলামিত্র অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাই আমরা চিন্তাভাবনা করছি কৃষকদের প্রতি ইলামিত্রের ত্যাগ ও ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নাবি জাত হিসাবে আমটির নামকরণ ‘ইলামতি’ করার। আমরা আমাদের দুই বছরের পর্যবেক্ষণ ও নাবি জাত হিসাবে আমটির সম্ভাবনার সামনে এনে এটিকে সম্প্রসারণে নতুন জাত হিসাবে মুক্তায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

 
Electronic Paper