ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কিশোরগঞ্জের হাওর যেন বাংলার খাদ্যগুদাম

সাজন আহম্মেদ পাপন, কিশোরগঞ্জ
🕐 ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৬, ২০২১

কিশোরগঞ্জের হাওর যেন বাংলার খাদ্যগুদাম

কিশোরগঞ্জকে বলা হয় হাওর অধ্যুষিত জেলা। ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, ভৈরব, বাজিতপুর, কুলিয়ারচর, কটিয়াদি, নিকলী, কিশোরগঞ্জ সদর, পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর, করিমগঞ্জ, তাড়াইলসহ মোট ১৩টি উপজেলায় হাওরের সংখ্যা ৯৭টি। হাওরের মাটি পলিগঠিত বিধায় খুবই উর্বর এবং প্রচুর ধান জন্মে। ধানই এলাকায় একমাত্র ফসল। পাশাপাশি কিশোরগঞ্জের মানুষের সবজির চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ হয় হাওর থেকে। দেশের অন্যতম মৎস্য ভা-ারও কিশোরগঞ্জের হাওর। বছরে প্রায় ২২,০৯৪.৫৩ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। ধানের চাহিদার প্রায় ৩০ ভাগ পূরণ হয় হাওরাঞ্চল থেকে এজন্য বাংলাদেশের অন্যতম খাদ্যগুদামও বলা হয়ে থাকে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলকে। এ অঞ্চলের ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় ২০১৮ মৌসুমে ২১৪৫০ হেক্টর, ২০১৯ মৌসুমে ২২৫০০ হেক্টর, ২০২০ মৌসুমে ২৪৪৫০ হেক্টর, ২০২১ মৌসুমে ২৩৯২০ হেক্টর জমিতে আউশ ধান চূড়ান্ত আবাদ করা হয়েছিল। জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী- এ চারটি উপজেলাকে মূল হাওর অধ্যুষিত এলাকা বলা হয়ে থাকে। এ চার উপজেলায় মোট আবাদি জমি রয়েছে প্রায় এক লাখ হেক্টর। জেলায় ২০১৮-১৯ মৌসুমে ১৬৭৫০০ হেক্টর, ২০১৯-২০ মৌসুমে ১৬৬৭১০ হেক্টর, ২০২০-২১ মৌসুমে ১৬৬৯৫০ হেক্টর জমিতে বোরো চূড়ান্ত আবাদ হয়েছিল। রোপা আমন ২০১৮ মৌসুমে ৭৯৬৮০ হেক্টর, ২০১৯ মৌসুমে ৮১২৫০ হেক্টর, ২০২০ মৌসুমে ৮২৭৫০ হেক্টর জমিতে চূড়ান্ত আবাদ করা হয়েছে। ২০২১ মৌসুমে জেলায় সবজি ৫৫৪০ হেক্টর, তিল ৮০ হেক্টর, চিনাবাদাম ১৮০ হেক্টর, মরিচ ৮৫০ হেক্টর, পেঁয়াজ ৭০ হেক্টর, মুগ ৫০ হেক্টর, ঢেঁড়স ৫৮৪ হেক্টর, চাল কুমড়া ৭২৪ হেক্টর , ঝিঙ্গা ১৮৮ হেক্টর, চিচিঙ্গা ৩৬৭ হেক্টর, করলা ৬৫০ হেক্টর, ডাঁটা ৪৮৫ হেক্টর, পুঁইশাক ২৬৭ হেক্টর, বরবটি ১১৬ হেক্টর, বেগুন ৫৬৪ হেক্টর, মিষ্টি কুমড়া ১৫৭ হেক্টর, ধুন্দল ৫০ হেক্টর, কচু ৪৭৫ হেক্টর, শশা ৪৭৭ হেক্টর, কাকরোল ৭১ হেক্টর, মুখিকচু ১৩৫ হেক্টর, পটল ১৯ হেক্টর, পান আলু/গাছ আলু ২১ হেক্টর জমিতে চূড়ান্ত আবাদ হয়।

বৈশাখ মাসে পাকা ধানের সোনালি রঙে সারা মাঠ সোনালি আকার ধারণ করে কৃষাণ-কৃষাণিরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে শুধু কাজ আর কাজ করে চলে দিন ভর। তবে চৈত্র মাসে আগাম পাহাড়ি ঢলে হাওরে বছরের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সবসময় কৃষকদের তাড়া করে। ফাল্গুন মাসে কিশোরগঞ্জের হাওরসমূহে পানির জন্য হাহাকার দেখা দেয় প্রায়ই। চারদিকে খাল বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। এঁটেল এবং দোআঁশ মাটির এসব এলাকায় মাটি ফেটে ধানখেতে গর্তের সৃষ্টি হয়। খাল এবং বিলে পানি না থাকার কারণে বিপাকে পড়েন জেলার ইটনা, মিঠাইমন, অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর, নিকলী উপজেলার কৃষক পরিবার। পাশাপাশি ইঁদুর কেটে সাবাড় করে উঠতি ধানের গোছা। অধিকাংশ নদ-নদীতে পলি পড়ে নাব্য হারিয়ে গেছে, কোনো কোনো স্থানে চর জেগে ওঠেছে। ফলে বর্ষা মৌসুম ছাড়া নদীগুলো নৌপথের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তেমনি নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় বোরো মৌসুমে বেশিরভাগ নদ-নদীর অংশ খাল-বিল কার্যত পানি সেচে কৃষকদের ফসল উৎপাদনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। অনেকের বোরো জমি থাকলেও সেচের অভাবে বছরের পর বছর অনাবাদি রাখতে বাধ্য হয়। সেচের অভাবে প্রতি বছর ৫-৬ শত একর ফসলি জমি এ হাওরে অনাবাদি থেকে যায়। আবার ধান সংরক্ষণের অভাবে কৃষকদের নামমাত্র মূল্যে ধান বিক্রি করে দিতে হয়। প্রতি বছর কমপক্ষে ছয় মাস জিরাতিরা থাকেন হাওরে। তাদের সরকারি সুবিধার আওতায় না আনতে পারলে ভবিষ্যতে ব্যাপক শ্রমিক সংকট হতে পারে বলে ধারণা করছেন কৃষি গবেষকরা।

ধান-চালের আড়ৎ মালিক খাইরুল ইসলাম জানান, এবার আবহাওয়া ভালো থাকায় সহজেই কৃষক মাঠের ধান কেটে মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানোর কাজ শেষে নিয়ে ফিরতে পেরেছেন। ধানের দাম আরও বাড়তে পারে। তাই কৃষকরা এবার ধান বিক্রি করছেন কম। মজুদের জন্য বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। হাওরের বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, তাদের আবাদকৃত ধানের মধ্যে স্থানীয় জাত, উফসী এবং হাইব্রিড জাতের ধান রয়েছে। তবে এ বছর প্রত্যেক জাতের ধানেরই ব্যাপক আবাদ হচ্ছে।

২০১৬ সালে মৎস্য উৎপাদনে প্রধানমন্ত্রী পদকপ্রাপ্ত অগ্রযাত্রা মৎস্য চাষি সমবায় সমিতি লি. এর সাধারণ সম্পাদক খাইরুল ইসলাম জানান, মৎস্য সম্পদকে রক্ষার জন্য প্রচুর পরিমাণে অভয়াশ্রম দরকার। কিশোরগঞ্জে ১১টি অভয়াশ্রম আছে। যদি প্রচুর পরিমাণে অভয়াশ্রম করা হয় তবে বিলুপ্তপ্রায় মাছ ফের ফিরে আসবে। আমাদের কিশোরগঞ্জ মৎস্য উৎপাদনে দেশে অন্যতম হলেও এখানে মাছের চিকিৎসার জন্য কোনো ল্যাব নেই। অনেক জেলে ডিমওয়ালা মাছ শিকার করে। তারা খুবই ধূর্ত। তাদের রুখে দিতে পারলে আমরা আরও এগিয়ে যাব।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কুমার পাল বলেন, প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মৎস্য আইন বাস্তবায়ন করছি। অভায়াশ্রম স্থাপন করা জরুরি। সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি। জলমহাল প্রকৃত জেলেরা অর্থাৎ নিবন্ধিত জেলেরা পাচ্ছে কিনা তা আমরা নিশ্চিত করি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল আলম বলেন, মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ হয়ে উদ্বৃত্ত থাকে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে এ জেলা। ধান সংরক্ষণের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গোডাউন এবং অটো রাইসমিলের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। জিরাতিদের সরকারি আওতায় আনা গেলে ভবিষ্যতে শ্রমিক সংকট থাকবে না।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, কৃষকদের বিভিন্ন রকমের কৃষি প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য কৃষকদের কম্বাইন্ড হারভেস্টর দেওয়া হচ্ছে। উৎপাদন খরচ কমে গেলে কৃষকদের লাভ বেশি হবে এবং তারা উদ্বুদ্ধ হবে উৎপাদন বাড়াতে। এতে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।

 
Electronic Paper