অতি লোভে সংকট বাড়ছে আলু বীজে
শাহাদাত স্বপন
🕐 ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৮, ২০২০
হঠাৎ বাজারমূল্য বাড়ায় হিমাগার থেকে প্রচুর পরিমাণে আলু বিক্রি করে দিচ্ছেন কৃষক। বেশি দাম পেয়ে বীজের জন্য রাখা আলুও বিক্রি করছেন তারা। এভাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত আলুর বাড়তি দাম থাকলে বড় ধরনের বীজ সংকটে পড়তে হবে কৃষকদের।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনÑবিএডিসিও বলছে, এ সংকট মোকাবিলায় তাদেরও হিমশিম খেতে হবে। তাছাড়া বীজ যতটুকু সংগ্রহ করা সম্ভব হবে, তা দিয়ে উৎপাদিত আলুর গুণগতমান ঠিক রাখা সম্ভব হবে কিনাÑএ নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক বছর বীজের মান খারাপ হলে এর প্রভাব পাঁচ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত থাকবে। ফলে যে কোনো মূল্যে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের উচিত আলুর বাড়তি দাম ঠেকিয়ে বীজ সংকট মোকাবিলায় তৎপর হওয়া।
বিগত বছরগুলোতে যেভাবে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের মধ্যে আগাম আলু উৎপাদন করা সম্ভব হতো, এ বছর তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এখন পর্যন্ত এ বছর আগাম আলুর বীজ রোপণ করতে পারেনি কৃষক। ফলে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের মধ্যে যে নতুন আলু উৎপাদন হতো, তা উৎপাদন করতে না পারায় পুরাতন আলু এমনকি বীজের জন্য সংরক্ষিত আলু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হবে। এতে বীজের বড় সংকট উঁকি দিচ্ছে।
এ বিষয়ে দিনাজপুর বীরগঞ্জের শাহী কোল্ডস্টোরের মহাব্যবস্থাপক আজগর আলী দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, বিগত বছরগুলোতে এ সময়ে খাবার হিসেবে সামান্য পরিমাণ আলু কৃষক হিমাগার থেকে বের করতেন। কিন্তু এ বছর বেশি দামের আশায় তারা আগেভাগেই আলু বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আলুর মূল্য ৩০ টাকা প্রতি কেজি নির্ধারণ করে দেওয়ার পর কৃষকের মধ্যে হিমাগার থেকে আলু বের করার প্রবণতা কিছুটা কমেছে। তাছাড়া বিগত বছরগুলোতে এ সময়ে আগাম উৎপাদনের জন্য বীজ হিসেবে ব্যবহারের জন্য হিমাগার থেকে আলু বের করা হতো। এ বছর রোপণের জন্য আলু না নিয়ে খাবারের জন্য নিয়ে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই বীজের একটা সংকট হবে।
বিএডিসির দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিবছর সারা দেশে সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন আলুর বীজ প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে বিএডিসির কাছে রয়েছে মাত্র ৩৫ হাজার মেট্রিক টন। যা সর্বমোট প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। বাকি বীজ ব্যবসায়িক কিছু প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ব্র্যাক, সিনজেন্টা, নীলসাগর গ্রুপসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সংরক্ষণ করে। সংরক্ষণ করা ও কৃষকের কাছে থাকা বীজ মিলে সারা দেশের চাহিদা পূরণ করা হয়। কিন্তু এ বছর সেখানে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে কথা হয় বিএডিসির বীজের দায়িত্বে থাকা মহাব্যবস্থাপক এস এম আলতাফ হোসেনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এ বছর অগ্রিম আলু উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে আলুর দাম বেশি হওয়ায় কৃষকের কাছে থাকা বীজ বিক্রি করে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে বীজের সংকট হতে পারে। বীজের সংকট কিছুটা জোড়াতালি দিয়ে পূরণ হলেও উৎপাদিত আলুর মান নিয়েও থাকবে সংকট। এক্ষেত্রে কতটুকু উন্নতমানের বীজ পাওয়া সম্ভব হবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ভালো দাম পাওয়ার জন্য কৃষক অনেক বীজ ইতোমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে। আগামী দুই মাসে আগাম আলু না আসায় আরও বিক্রি করবে। ভালো বীজ খাবার আলু হিসেবে বিক্রি হওয়ায় পরবর্তী ফলন কেমন হবে- সেটা নিয়েও শঙ্কা আছে।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, দেশে কোলন পদ্ধতি অনুসরণ করে আলুর বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে এ ধরনের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তবে কোলন পদ্ধতির মাধ্যমে এখন পর্যন্ত বীজের সংকট মোকাবিলা করার অবস্থা তৈরি হয়নি।
এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ব্যবসায়ীরা নৈতিকতার বাইরে গিয়ে প্রতিকেজি আলুতে অন্তত ২০ টাকা লাভ করছেন। আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে। এছাড়া অতি বন্যার কারণে অন্যান্য সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে করে আলুর চাহিদা বেড়ে গেছে। এ সুযোগে কৃষক হয়তো বীজের জন্য রাখা কিছু আলু বিক্রি করে ফেলছে। তবে আমরা আলুর দাম কমাতে চেষ্টা করছি। আশা করি নতুন আলু আসার আগেই দাম কমে যাবে।
কৃষিমন্ত্রী আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, যে দামে ব্যবসায়ী আলু কিনেছে, কত লাভ করবে তারা? কিনেছে ১৭ থেকে ১৮ টাকা করে। কিন্তু এটা তাদের ৪৫-৫০ টাকা করে কেন বিক্রি করতে হবে? এই লাভ করার প্রবণতা, ন্যূনতম একটা নৈতিকতা তাদের মধ্যে কাজ করে না। এক কেজি আলুতে ২০ টাকা লাভ করা কি সহজ কথা? বর্তমানে চাহিদার কারণে তারা সে সুযোগ নিচ্ছে।
এটা নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসন চেষ্টা করছে। তবে বাস্তবে এটা করা যায় না। বাজারে চাহিদা এবং ব্যবসায়ীদের নানা কারসাজির কাছে এটা করা খুব কঠিন। তবে আমরা চেষ্টা করছি। আমরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছি না।
এ পরিস্থিতিতে কৃষি বিপণন অধিদফতর তিন পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নে সব জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছে। কেজিপ্রতি খুচরা পর্যায়ে ৩০, পাইকারিতে ২৫ ও হিমাগার থেকে ২৩ টাকা। এ দামে আলু বিক্রি না করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।