ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ঐতিহ্যের খেজুর গুড়

মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী
🕐 ৬:৪১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২১, ২০১৯

খেজুর রস শীতকালে গ্রামীণ মানুষের জীবন-জীবিকায় যেন এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। খেজুর গাছের সঙ্গে চাষিদের অঙ্গাঙ্গিভাবেই বসবাস হয়ে উঠেছে। চাষির জীবন সংগ্রামে অনেক কষ্টের মাঝে প্রাপ্তিই যুক্ত হয় খেজুর গাছের সঙ্গে। ভূমিহীন চাষি, প্রান্তিক চাষি, দরিদ্র মানুষের জন্যই যেন শীতকালটা আনন্দদায়ক। কারণ খেজুর গাছই তো চাষির অন্নদাতা।

হেমন্তের শেষে শীতের পরশে চাষি খেজুর গাছের মিষ্টি রসে নিজেকে ডুবিয়ে নেওয়ার সুন্দর মাধ্যম সৃষ্টি করে। আবহমান গ্রামবাংলার চাষিদের যেন একঘেয়েমির যান্ত্রিকতায় জীবনযাপনের অনেক পরিবর্তন আনে শীতকালের ঋতুচক্র। খেজুর গাছের যত্ন-আত্তি না করলে যে রস মিলবে না। আর রস না মিললে গুড় হবে কি করে। পাটালি না দেখলে যেন ঘুম আসে না চাষির। মেয়ে বা বউয়ের হাতের কাঁচা সুপারির কচি পান গালে ভরে বাঁশের ডালি মাথায় করে গঞ্জে বা দূববর্তী হাটে যাবেই বা কি করে।

গ্রামে খুব ভোরে খেজুর গাছ থেকে রসের হাড়ি নামিয়ে আনতে ব্যস্ত হন চাষি। রাতের শীতল রস ভোরে হাড় কাপানি ঠাণ্ডায় গাছ থেকে নামিয়ে খাওয়ার যে স্বাদ তা একেবারেই যেন খুব আলাদা। আসলে ভোর বেলায় রস খেলে শীত আরও জেঁকে বসে। আবার শীতে শরীর কাপানির এক স্পন্দন যেন চরম আনন্দদায়ক। শীত লাগে লাগুক না কেন, তবুও রস খাওয়ার কোনো বিরাম নেই। এক গ্লাস, দুই গ্লাস খাওয়ার পরপরই কাপতে কাপতে যেন আরও এক গ্লাস মুড়ি মিশিয়ে মুখে তুলে চুমক দেওয়া আর রোদ পোহানো সে যে কি আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা দূরহ।

খেজুর গাছ ছয় সাত বছর বয়স থেকে রস দেওয়া শুরু করে। পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত রস দেয়। গাছ পুরনো হয়ে গেলে রস কমে যায়। আর পুরনো খেজুর গাছের রস খুব মিষ্টি হয়। মাঝ বয়সী গাছ থেকে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করা গাছের জন্য অবার অনেক ক্ষতিকর। রস সংগ্রহের জন্য কার্তিক মাসে খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়। কার্তিক মাস থেকেই রস পাওয়া যায়। রসের ধারা চলতে থাকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত।

শীতের সঙ্গে রস ঝরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। শীত যত বেশি পড়বে তত বেশি রস ঝরবে। রসের স্বাদও তত মিষ্টি হবে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ হলো রসের ভর মৌসুম। অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত একটি খেজুর গাছে মাসে ৪০ কেজি রস পাওয়া যেতে পারে।

চাষিরা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান এ গাছ থেকে সে গাছে। মাটিতে পা ফেলার ফুরসতটুকুও পায় না অভাবি এ মানুষগুলো। শীত আসা মাত্রই খেজুর গাছ কাটার জন্য অনেক আগে থেকেই সকাল-সন্ধ্যায় যেন লেগে থাকে চাষি। খেজুর গাছ বিশেষ কায়দায় কাটতে হয়। আর এ গাছগুলো কাটে যারা তাদের গাছি বলা হয়। বিভিন্ন উপকরণের সমন্বয়ে গাছি নামধারি মানুষ পরিচ্ছন্নভাবে গাছ কাটার জন্য ব্যস্ত হয়ে যান। তারা গাছ কাটতে ব্যবহার করেন দা, দড়ি, এক টুকরো চামড়া বা পুরনো বস্তা আবার দা রাখার জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি থলি বা ঝাঁপি।

সে ঝাঁপি গাছিরা রশি দিয়ে খুব যত্নে দা রেখে এ গাছ থেকে সে গাছে উঠানামা করে সুবিধা পায়। আবার কোমরে বেশকিছু চামড়া বা বস্তা বেঁধে নেয় যেন গাছে উঠা নামায় কোনো প্রকার সমস্যা না। গাছ কাটার জন্য গাছি শরীরের ভারসাম্য রক্ষার সময় কোমর বরাবর গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে নেয়। দড়িটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। এ দড়ির দুই মাথায় বিশেষ কায়দায় গিট দেওয়া থাকে। গাছে উঠার সময় গাছি অতি সহজে মুহূর্তের মধ্যে গিঁট দুটি জুড়ে দিয়ে নিজের জন্য গাছে উঠার নিরাপদ ব্যবস্থা করে নেয়।

রস জ্বাল দিতে যে পরিমাণ জ্বালানির প্রয়োজন তা পাওয়া যায় না এমন আক্ষেপে চাষির বউ ঝগড়া করলেও চালের আটায় তৈরি ভাপা পিঠা খেজুরের গাঢ় রসে ভিজিয়ে খাওয়ার পর যেন সব রাগ মাটি হয়ে যায়। আবার কখনও সখনও চাষির বউকে এক প্রকার সান্তনা দিয়ে বলে অভাবের সংসারে যা আছে তা দিয়ে এ পেশা চালালে বাঁচা যাবে কি করে। বছরে পাঁচ মাস ধরেই তো খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করা হয়। আর তা খড়কুটার জ্বালানিতে গুড় বানিয়ে বাজারে বিক্রি হয় বলেই কোনোমতে পেট চলছে। বউ আবার মুচকি হাসি দিয়েই বলে, সংসার চলছে তো ভালোই কিন্তু মেয়ের বিয়ের জন্য ভাবো কিছু। তার তো বিয়ের বয়স হয়েছে, এমন কথাও চলে আসে খেজুর গাছির ছোট্ট পরিবারে।

চাষির খেয়াল তো আছে বৈকি তবে আরও পরিশ্রম ও কষ্ট করার প্রয়োজন হবে, সামনের শীতে চাষির ইচ্ছা আরও বেশ কিছু খেজুর গাছ বর্গা নিলেই মেয়ের বিয়ের কিছু টাকা হাতে আসবে। এমন কথা সচরাচর শোনা যায় খেজুর চাষির কণ্ঠে। চাষির আদরের মেয়ে জামাইকে দাওয়াত দিয়ে খেজুর রসের পিঠা পায়েসের তৈরির ধুম পড়ে।

গাছ কাটার জন্য গাছের মাথার এক দিকের শাখা কেটে পরিষ্কার করে সেই কাটা অংশেরই নিচ বরাবর দুটি খাঁজ কাটার প্রয়োজন পড়ে। সে খাঁজ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে একটি সরু পথ বের করা হয়। এ সরু পথের নিচে বাঁশের তৈরি নলি বসানো হয়। এ নলি বেয়ে হাড়িতে রস পড়ে। নলির পাশে বাঁশের তৈরি খিল বসানো হয়। সে খিলেই মাটির হাড়ি টাঙিয়ে রাখা হয়। বিকেল থেকে হাড়িতে রস জমা হতে হতেই সারা রাত্রিতে হাড়ে পূর্ণ হয়। গাছ কাটার পর দুই তিন দিন রস পাওয়া যায়।

গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয়। হাড়িকে আবার অনেকে বলে ভাড়। ঠিলা হিসেবেও হাড়ির নাম ব্যবহার হয়। যে যাই বলুক না কেন, ভাড়টি আসলেই খুব ছোট আকৃতির কলসের মতো হয়ে থাকে। মাঝারি আকৃতির দশ বা পনেরো ভাড় রস জ্বাল দিয়েই এক ভাড় গুড় হয়। সেই গুড়ের ওজন ছয় থেকে আট কেজির মতো বলা চলে।

গুড় তৈরির জন্য রস জ্বাল দেওয়া হয় মাটির জালায় বা টিনের তাপালে। খুব সকালে রস নামিয়ে এনেই জ্বালানো হয়। জ্বাল দিতে দিতে এক সময় রস ঘন হয়ে গুড় হয়ে যায়। এ গুড়ের কিছু অংশ তাপালের এক পাশে নিয়ে বিশেষভাবে তৈরি একটি খেজুর ডাল দিয়ে ঘঁষতে হয়। ঘঁষতে ঘঁষতে এ অংশটুকু শক্ত হয়ে যায়। আর শক্ত অংশকেই আবার কেউ কেউ বীজ বলে থাকে। বীজের সঙ্গে তাপালের বাকি গুড় মিশিয়ে স্বল্পক্ষণের মধ্যে গুড় জমাট বাঁধতে শুরু করে।

তখন এ গুড় মাটির হাঁড়ি বা বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে রাখার প্রয়োজন পড়ে। সে গুড় দেখলে বোঝা যাবে, একেবারে জমাট বেঁধে পাত্রের আকৃতি ধারণ করেছে।

 
Electronic Paper